ঢাকা ০১:১১ পিএম, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গল্প : পৌষ সংক্রান্তির শোক // কলি চক্রবর্তী 

  • আপডেট সময় : ০৯:২১:৩৪ পিএম, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪
  • ৬৬৯

 

ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তখন আমি, পড়া লেখার পাশাপাশি টুকিটাকি ঘরের কাজে ও সাহায্য করতাম। দুরন্তপনা বেশি ছিল বলে বাবা, পিসি ,কাকা ঠাকুমা সবাই আদর করতেন।
ভীষণ চঞ্চল থাকলেও পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে
আমি তা উপলব্ধি করতাম।

সাদা মাটা চলাফেরায় বাড়ির এবং আশেপাশের মানুষ ও
ভীষণ স্নেহ করতেন। আমার সব হাসি ঠাট্টা হতো ভাই বোন বাবা এবং বাড়ির মানুষের সাথে। বাবা যখন সাথে থাকতেন
তখন সবাই কে খুব হাসাতেন।
মা জেঠিমা সকল ভাই বোন মিলে হৈ হৈ রই রই ছিল
আমাদের বাড়িতে। রাত পোহালেই পৌষ সংক্রান্তি,
এ দিনটি এসে আমাদের চার ভাই বোনের
মা বাবাকে হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।

আজ এ সকল কথা প্রকাশ করছি কারণ আজ আমার এবং
আমার ভাই বোনের জন্য একটি মর্মস্পর্শী শোকের দিন।
চৈত্র সংক্রান্তি যত দিন আসবে?
আর বার বার মনে হবে এ দিনে বাবাকে হারানোর কথা।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবা হৃদরোগ ধরা পড়ে,
হৃদ রোগ হওয়ার পর, বাবা চিন্তায় থাকতেন।
বাবার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বুঝতে পারতাম, বাবা চিন্তা করছেন।
মাঝে মাঝে বাবা সারা রাত বুক ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠতেন,
আমি বাবা কে ঔষধ খাইয়ে শিয়রে বসে থাকতাম একটা চেয়ার নিয়ে। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছিল,
একবার এমন অবস্থা হয়েছে,বুক ব্যাথায যন্ত্রনায় বাবা
ভেবেছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না।

তাই অনর্গল বলতে লাগলো একটা কলম আর খাতা নিয়ে
আমাকে ,আমি খাতা কলম নিয়ে বসি আর ভয়ে কাঁদতে শুরু করি । বুকের প্রচন্ড ব্যাথায় কার কার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন আছে, কত টাকা কার কাছে পাবেন বাবা।
বাবার কাছে কে কত টাকা পাবেন এ সব লিখতে বলেছিলেন। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া মেয়ে হিসাবে এত পাকা পোক্ত নয় কিন্তু বাবা যে ভাবে লিখতে বলেছিলেন?
সে ভাবেই লিখি‌, লিখতে লিখতে বাবাকে বলি
: আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে বাবা?
এ কথা শুনে কান্না করে দিয়েছেন বাবা।
বাবা জিজ্ঞেস করল:তোমরা বাবাকে বেশি ভালোবাস তাই না?
বাবার এমন প্রশ্নে আমি উত্তর দিতে পারিনি।
শুধু চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল পড়ছিল।
বাবা বুঝিয়ে বললেন কেঁদো না মা, আমি ভালো হয়ে যাবো।

বাবা সে দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন , ভালো ভাবে নিজের চিকিৎসা করবেন। তিন মাসের মধ্যে বাবা ভারতে যেতে পাসপোর্ট করলেন ‌। বাবা যে দিন ভারত যাবেন ,তার আগের দিন রাতে আমাকে অনেক কিছু বুঝালেন ।
ভাই বোনের খেয়াল রাখতে, রাতে ঘরের দরজা ভালো করে
লাগিয়ে ঘুমাতে,ভয় না পেতে।
এ কথা গুলো এখনো ভীষণ কানে ভাসে। বাবা নেই এ কথা
মানতে এখনো কষ্ট হয় ।

হার্টের অপারেশনের জন্য বাবা ভারত চলে যান
তখন মোবাইল ফোন ছিল না তাই রোজ বাবার জন্য খারাপ লাগতো। কেমন আছেন?
কি অবস্থায় আছেন বাবা?
এ ভাবে দেড়মাস পর বাবা ফিরে এলেন।
বাবার চিকিৎসা করেছেন ড: দেবীশেঠি।
বাবার মুখে শুনেছি ৫ বছরের জন্য হার্টে রিং বসানো হয়েছে।
পাঁচ বছর পর আবার চিকিৎসা করতে যেতে হবে।

ভারত থেকে চিকিৎসা হয়ে আসার ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন মা স্ট্রোক করে বাম হাত বাম পা প্যারালাইসিস হয়ে যায়। শুরু হয় আমার জীবনের আরেকটি দুঃখময় অধ্যায়।
রোজ মায়ের সাথে ঘুমাতাম ,মা সারারাত ঘুমাতেন না,
তখন আমার বয়স ১৩ বছর রাতের বেলা মাকে প্রস্রাব করাতে উঠতে হতো ৭-৮ বার।
বাবাকে আমি জাগতে দিতাম না। যতটুকু সম্ভব আমি চেষ্টা করতাম মায়ের সেবা যত্ন করার। রাতের বেলা মা বলতেন মায়ের পা বাঁকা হয়ে আসছে। মাকে জিজ্ঞেস করতাম কি করলে তোমার ভালো লাগবে?
মা বলল পা তুলে ধর উপরে ,খুব বেশি বড় হইনি তখন।
মায়ের পা ভারি মনে হতো তাই কাঁধে নিয়ে বসে থাকতাম
ঘন্টার পর ঘন্টা।এ ভাবে রাখলে মায়ের ভালো লাগতো।
তাই কষ্ট হলেও মাঝে মাঝে চেষ্টা করতাম এমন করে রাখার।
প্রায়দিন রাতে ঘুমাতে পারতাম না, মেজাজ খিটখিটে থাকত

সকালে উঠে সকালের কাজ স্কুলে যাওয়া নিজের পড়া ঠিক রাখা আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে যেত।
মায়ের সাথে মাঝে মাঝে রেগে যেতাম।
মায়ের সাথে রেগে গেলে সবাই বলতো, মায়ের সাথে এমন কেন করি?
কিন্তু রাতের পর রাত জেগে থাকা কথাটা কেউই জানতো না।

এসএসসি পরীক্ষার আগে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় মা আমাকে চিৎকার করে ডাকে, দৌড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে মা? মা বলল: আমার বুকে ব্যথা খুব খারাপ লাগছে।
ভেবেছিলাম জর্দা সাদা পাতা দিয়ে পান খাওয়াতে হয়তোবা বুকে ধরেছে। মুখ থেকে পান ফেলতে বললাম কিন্তু মা ফেলল না।
মা বলল: আমাকে জল এনে দে ?
দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস জল এনে দেই। জল খেয়ে নেয় মা
তারপরও চিৎকার করে বলে আমার বুকে খারাপ লাগছে, আমাকে বেশি করে জল দে না মা?
দৌড়ে টিউবয়েলে চলে যাই ,এক জগ জল এনে গ্লাসে করে খেতে দিতেই, মা বলে জগ আমার হাতে দে?
জগ তুলে দিতেই : ঢক ঢক করে প্রায় একজগ জল খেয়ে নেয় মা। কিন্তু তবুও মায়ের খারাপ লাগা কমেনি এক ফোটাও।সেই সময় ও পৌষ মাসের ২১ তারিখ ছিল।

মাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেই। হাতের তালু পায়ের তালু ধরে দেখি ঠান্ডা তারপর তেল গরম করে মালিশ করতে থাকি
বাজার থেকে বাবাকে ডাক্তার নিয়ে আসতে খবর দেই।
মা আমার হাত টেনে ধরে বলল : অনু মাধুকে তুই দেখিস।
এ কথা শুনে আমরা চার ভাই বোন কাঁদতে শুরু করলাম।

আর মা নারায়ন নারায়ন বলতে বলতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । ডাক্তার নিয়ে আসে বাবা, কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। মা নেই,মা নেই, মা ,,,,
ছোট বোনের বয়স তখন ৫ বছর।
ও শুধু জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে মায়ের?
ও মাকে ডাকছে মা মা উঠোনা।

জীবনের সাথে কাজের লড়াই করি ,এ দিকে বাবার ৫ বছর হয়ে গেছে রিং বসানোর । আমি বড় হয়ে গেছি বলে বাবা
চিকিৎসা করতে যেতে চাইছিলেন না।
আমরা সবাই মিলে বলি কিন্তু বাবা আমাদের কথার গুরুত্ব দেননি ,বাবা বলতেন কিছুই হবে না।
বাবা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, আমাদের কথা শুনে বাবা বলতেন, ভগবান জানে আমি ছাড়া তোমাদের কেউ নেই।
তাই এত চিন্তা করবে না তোমরা।

এ ভাবে যখন সাত বছর হয়ে গেলো একদিন হঠাৎ
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা সেই দিন টি পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন
পাটালী গুড়ের পায়েস রান্না করে ছিলাম।
বাবা কে বললাম একটু পায়েস দেবো বাবা?
বাবা:অল্প করে দিও মা।
বাবা আমার নাম ধরে তেমন ডাকতেন না।
সব সময় মা বলে ডাকতেন।
আমি অসুস্থ হলে জ্বর আসলে? বাবাই মাথা ধুয়ে দিতেন
ঔষধ খাইয়ে দিতেন।
খাবার খাইয়ে দিতেন।
আমার সকল কিছুর পরম অনুপ্রেরণা আমার বাবা।

আর বাবারও ছোট বেলায় মা হারিয়েছেন বলে আমায়
মা ডেকে আত্মতৃপ্তি পেতেন বাবা।
যা বলছিলাম?
দু চামচ পায়েস বাবা মুখে দিলেন। দোতলায় বাবার রুমে গেলেন ঘুমাতে, এদিকে আমি রাতে সবার খাবার শেষে বাসনপত্র পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে রেখেছি।
পরের দিন সকালবেলা পৌষ সংক্রান্তি। ভোরবেলা উঠে সূর্যকে পিঠা দিতে হবে ,উঠানে আলপনা করতে হবে চাউলের গুড়ি দিয়ে। রাত তখন বারোটা কাজ শেষে আমি যখন ঘুমোতে যাবো, বাবা ডাক দিলেন: মা দেখে যা।

বাবার কক্ষে গিয়ে দেখি বাবা ভীষণ রকম কাশছেন।
বাবাকে কাশতে দেখে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি সাথে সাথে বলি আপনার রিং এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বাবা আপনার চিকিৎসাটা পুনরায় করার দরকার ছিল। বাবা বলল আরে না আমার ঠান্ডা লেগেছে তাই কাশি আসছে।
সরিষার তেল গরম করে বাবার বুকে ঘসে দেই,
পায়ের তালুতে ঘষে দেই।
বাবা বললেন গরম জল খাবেন, মাটির উনুন ছিল ঘরের বাইরে ‌। অন্ধকারে ঘরের বাইরে গিয়ে গরম জল করতে ভয় লাগছিল, রাতের আঁধারে খালের ওপারে শেয়াল গুলো খুব জোরে জোরে ডাকছে। তবুও বাবা বলেছে তাই দেরি না করে
মনে মনে জপ করতে করতে গরম জল করে আনি।

বাবা গরম জল খায়।
বাবাকে জিজ্ঞেস করি: এখন কেমন লাগছে বাবা?
বাবা বলল আগের চাইতে একটু ভালো, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পরো মা।
বাবাকে গরম জল দিয়ে, বাকি গরম জল ফ্লাক্সে ঢুকিয়ে বাবার শিয়রে টি টেবিলে রেখে আসি।
তখন রাত ২:৩০ মিনিট। হঠাৎ কাকাদের গোয়াল ঘরের গরু
অদ্ভুত রকম আচরণ করতে লাগলো।
গরুটা ভীষণ জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। বেঁধে রাখা অবস্থায় খুব লাফাতে লাগলো ।
গরুর এমন অবস্থা দেখে মনে মনে আমার ভীষণ ভয় হচ্ছিল
অমনি বাবা আবার ডাকতে শুরু করলেন।
দৌড়ে গেলাম আবার দোতলায়, গিয়ে দেখি বাবার কাশি অনেকটা বেড়ে গেছে, কিন্তু তখনো গরুর চিৎকার থামছে না
কিছুক্ষণ পর উঠোনে দাদার পোষা দুটো কুকুর কান্না করতে লাগলো । পোষ্য প্রাণীদের এমন আত্মচিৎকার দেখে আমার বুকের ভেতরটা মোচোড়দিয়ে উঠলো।
বাবা কে আবার গরম জল দিলাম একটু চা করে দিলাম।
বাবা খেলেন, আর বললেন :আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না মা?
আমি বললাম না বাবা, কিসের কষ্ট।
এভাবে রাত তিনটা বাজলো দাদাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনলাম। আর বললাম একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে দাদা আমার কাকাতো ভাইকে নিয়ে ডাক্তার বাড়িতে ছুটলেন ।
ডাক্তার অরুন দাস পল্লী চিকিৎসক আমাদের গ্রামে তখন তিনি এবং ডাক্তার অতুল দাস (মামা) মানুষের চিকিৎসা করতেন।

ডাক্তার অরুণ দাদুকে নিয়ে ,দাদা আসলো। অরুণ দাদু চেকআপ করে বললেন তেমন সমস্যা না ঠান্ডার সমস্যা ,ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার দাদুর মুখের কথা শুনে স্বস্তি পেলাম।
বাবাকে কিছু ঠান্ডার ঔষধ দিলেন ।
বাবার যখন বারবার কাশি হচ্ছিল তখন আমি একটা তেলের কন্টেইনার কেটে বাবার বালিশের পাশে রাখলাম, থুতু যেন সেই কন্টেইনারে ফেলে। কারণ অতিরিক্ত কাশির কারণে বাবাকে বারবার বিছানা থেকে উঠতে হচ্ছিল ,কন্টেইনারে থুথু ফেললে ,বাবার কষ্ট কম হবে।

ডাক্তার অরুণ দাদুকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন দাদা।
বাবা বললেন এবার সবাই ঘুমাও গিয়ে।
আমি একটি চেয়ার নিয়ে বাবার পাশে বসে রইলাম।
তখন বাবার একটু ঘুম লাগছিলো।
এ ভাবে রাত ৪:৩০ মিনিট। বাবাকে ঘুমোতে দেখে, আমি জানালার পাশে গিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে তাকালাম।
গরুটা তখনো কাঁদছে।
ভগবানের নাম নিলাম বসে বসে।এ ভাবূ ভোর হয়ে এসেছে।
আমি চলে গেলাম পৌষ সংক্রান্তি দিনের সূর্যকে পিঠা দিতে। তখন বাবা আবার ডাক দিলেন।
গিয়ে দেখি বাবার নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। দাদাকে জাগিয়ে বাবার জেঠাতো ভাই ভোলা কাকাকে সহ হাসপাতালে পাঠালাম।
ঘরে অস্থিরতা কমেছিল না।
আমি যেতে চেয়েছি ওরা আমাকে নেয়নি।
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে খবর আসে আমরা সবাই হাসপাতালে যাওয়ার।
হাসপাতালে গেলাম বাবার মুখে অক্সিজেন দেওয়া গায়ের বর্ণ কাঁচা হলুদের মত।
আমাকে বাবা হাতের ইশারায় ডেকেছেন।
কিন্তু বাবাকে বিবর্ণ দেখে আমি সামনে যেতে চাই ছিলাম না।
অজানা ভয় গ্ৰাস করছে ।
আমাদের সাথে জেঠিমা গিয়েছিল হাসপাতালে,
জেঠিমা আমার হাতে ধরে বাবার কাছে নিয়ে যায়
বাবা মাথায় হাত রেখে বলতে চাইছিলো কিছু, কথা গুলো স্পষ্ট ছিল না।

ডাক্তার এসে বললেন রুগিকে ঢাকা রেফার করতে হবে।
শুরু হলো অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার তোড় জোর।
আমি বললাম: আমি ও যাবো। ওরা আমাকে নিলো না।

বাবাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় আর আমরা বাড়িতে রিক্সায় করে আসি।
বাড়িতে এসে মন্দিরে মানত করি বড় করে পূজা করবো
বাবা যদি সুস্থ্য হয়।

কিছুক্ষণ পর বৌদি আসে আমাকে বলে একটু ভাত খা।
আমি বললাম না। বাবা বাড়িতে আসলে খাবো।
বৌদি জোর করে তিন বোনের মুখে ভাত তুলে দিতেই
অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পাই।
অতুল মামা বাবা বন্ধু ছিল।
মামা আমাদের বাড়িতে দরজার সামনে কান্না করছেন
তখনো বুঝিনি বাবা আর নেই।

পুকুরের পাড় থেকে জোরে জোরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে
দাদার আমি দৌড়ে যেতেই সবাই আমাকে ধরে ফেলে।
ঠাকুর ঘরে শুয়ে রাখা হয় বাবাকে।
আমার বাবা গত রাতে ঘুমাতে পারেনি।
এখন কত নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
ওরা বাবার চোখে তুলসী পাতা দিয়েছে আমি তা ফেলে
দিয়েছি। ওদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
ওরা কেউ বোঝে নি।
ওরা কেউ বুঝতে চাইলোই না।
জেগে ওঠার জন্য আমি বাবা কে জল খেতে দিয়েছি,
হাত পা টেনে দিয়েছি কিন্তু বাবা আর সে দিন জাগে নি।
এখন আর বিপদে মানত করি না ‌।
এখন বলি সব তো তোমার ইচ্ছায়।
আমার বলে এখানে কিছুই নেই ‌।
আমার কান্না করার অনুভূতি নেই দাদাকে দেখছি চিৎকার করে কাঁদছে ‌।
আমাদের কার কাছে দিয়ে গেলেন বাবা ‌
ছোট দুই বোন কাঁদতে কাঁদতে নিশ্চুপ হয়ে গেছে ‌।
আর আমি তখন নিজেকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছি , হয়তো আরো যুদ্ধ করতে হবে আমাকে সময়ের সাথে। বাবা মারা যাওয়ার পর চাইলেও হাসতে পারতাম না,হাসির বদলে বুক ভরে
উঠতো নীরবে হারানোর যাতনায়। আগে সব কিছু নিয়ে খুব বেশি দুষ্টামি চঞ্চলতা করতাম বলে সবাই কতইনা আমাকে শাসনে রাখতেন। আর মা বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকটা গম্ভীর যখন হয়ে যাই তখন সবাই কতই চেষ্টা করতো একটু হাসাতে ,দৈবেরবান বড়ই কঠিন
তাই রয়েছে হৃদয় মলিন,
তাই পুড়িয়েছি সুখ শান্তি
জীবন গড়েছি মমতা বিহীন।

বাবা আজ পৌষ সংক্রান্তি ।

গল্প : পৌষ সংক্রান্তির শোক // কলি চক্রবর্তী 

আপডেট সময় : ০৯:২১:৩৪ পিএম, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪

 

ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তখন আমি, পড়া লেখার পাশাপাশি টুকিটাকি ঘরের কাজে ও সাহায্য করতাম। দুরন্তপনা বেশি ছিল বলে বাবা, পিসি ,কাকা ঠাকুমা সবাই আদর করতেন।
ভীষণ চঞ্চল থাকলেও পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে
আমি তা উপলব্ধি করতাম।

সাদা মাটা চলাফেরায় বাড়ির এবং আশেপাশের মানুষ ও
ভীষণ স্নেহ করতেন। আমার সব হাসি ঠাট্টা হতো ভাই বোন বাবা এবং বাড়ির মানুষের সাথে। বাবা যখন সাথে থাকতেন
তখন সবাই কে খুব হাসাতেন।
মা জেঠিমা সকল ভাই বোন মিলে হৈ হৈ রই রই ছিল
আমাদের বাড়িতে। রাত পোহালেই পৌষ সংক্রান্তি,
এ দিনটি এসে আমাদের চার ভাই বোনের
মা বাবাকে হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।

আজ এ সকল কথা প্রকাশ করছি কারণ আজ আমার এবং
আমার ভাই বোনের জন্য একটি মর্মস্পর্শী শোকের দিন।
চৈত্র সংক্রান্তি যত দিন আসবে?
আর বার বার মনে হবে এ দিনে বাবাকে হারানোর কথা।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবা হৃদরোগ ধরা পড়ে,
হৃদ রোগ হওয়ার পর, বাবা চিন্তায় থাকতেন।
বাবার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বুঝতে পারতাম, বাবা চিন্তা করছেন।
মাঝে মাঝে বাবা সারা রাত বুক ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠতেন,
আমি বাবা কে ঔষধ খাইয়ে শিয়রে বসে থাকতাম একটা চেয়ার নিয়ে। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছিল,
একবার এমন অবস্থা হয়েছে,বুক ব্যাথায যন্ত্রনায় বাবা
ভেবেছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না।

তাই অনর্গল বলতে লাগলো একটা কলম আর খাতা নিয়ে
আমাকে ,আমি খাতা কলম নিয়ে বসি আর ভয়ে কাঁদতে শুরু করি । বুকের প্রচন্ড ব্যাথায় কার কার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন আছে, কত টাকা কার কাছে পাবেন বাবা।
বাবার কাছে কে কত টাকা পাবেন এ সব লিখতে বলেছিলেন। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া মেয়ে হিসাবে এত পাকা পোক্ত নয় কিন্তু বাবা যে ভাবে লিখতে বলেছিলেন?
সে ভাবেই লিখি‌, লিখতে লিখতে বাবাকে বলি
: আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে বাবা?
এ কথা শুনে কান্না করে দিয়েছেন বাবা।
বাবা জিজ্ঞেস করল:তোমরা বাবাকে বেশি ভালোবাস তাই না?
বাবার এমন প্রশ্নে আমি উত্তর দিতে পারিনি।
শুধু চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল পড়ছিল।
বাবা বুঝিয়ে বললেন কেঁদো না মা, আমি ভালো হয়ে যাবো।

বাবা সে দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন , ভালো ভাবে নিজের চিকিৎসা করবেন। তিন মাসের মধ্যে বাবা ভারতে যেতে পাসপোর্ট করলেন ‌। বাবা যে দিন ভারত যাবেন ,তার আগের দিন রাতে আমাকে অনেক কিছু বুঝালেন ।
ভাই বোনের খেয়াল রাখতে, রাতে ঘরের দরজা ভালো করে
লাগিয়ে ঘুমাতে,ভয় না পেতে।
এ কথা গুলো এখনো ভীষণ কানে ভাসে। বাবা নেই এ কথা
মানতে এখনো কষ্ট হয় ।

হার্টের অপারেশনের জন্য বাবা ভারত চলে যান
তখন মোবাইল ফোন ছিল না তাই রোজ বাবার জন্য খারাপ লাগতো। কেমন আছেন?
কি অবস্থায় আছেন বাবা?
এ ভাবে দেড়মাস পর বাবা ফিরে এলেন।
বাবার চিকিৎসা করেছেন ড: দেবীশেঠি।
বাবার মুখে শুনেছি ৫ বছরের জন্য হার্টে রিং বসানো হয়েছে।
পাঁচ বছর পর আবার চিকিৎসা করতে যেতে হবে।

ভারত থেকে চিকিৎসা হয়ে আসার ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন মা স্ট্রোক করে বাম হাত বাম পা প্যারালাইসিস হয়ে যায়। শুরু হয় আমার জীবনের আরেকটি দুঃখময় অধ্যায়।
রোজ মায়ের সাথে ঘুমাতাম ,মা সারারাত ঘুমাতেন না,
তখন আমার বয়স ১৩ বছর রাতের বেলা মাকে প্রস্রাব করাতে উঠতে হতো ৭-৮ বার।
বাবাকে আমি জাগতে দিতাম না। যতটুকু সম্ভব আমি চেষ্টা করতাম মায়ের সেবা যত্ন করার। রাতের বেলা মা বলতেন মায়ের পা বাঁকা হয়ে আসছে। মাকে জিজ্ঞেস করতাম কি করলে তোমার ভালো লাগবে?
মা বলল পা তুলে ধর উপরে ,খুব বেশি বড় হইনি তখন।
মায়ের পা ভারি মনে হতো তাই কাঁধে নিয়ে বসে থাকতাম
ঘন্টার পর ঘন্টা।এ ভাবে রাখলে মায়ের ভালো লাগতো।
তাই কষ্ট হলেও মাঝে মাঝে চেষ্টা করতাম এমন করে রাখার।
প্রায়দিন রাতে ঘুমাতে পারতাম না, মেজাজ খিটখিটে থাকত

সকালে উঠে সকালের কাজ স্কুলে যাওয়া নিজের পড়া ঠিক রাখা আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে যেত।
মায়ের সাথে মাঝে মাঝে রেগে যেতাম।
মায়ের সাথে রেগে গেলে সবাই বলতো, মায়ের সাথে এমন কেন করি?
কিন্তু রাতের পর রাত জেগে থাকা কথাটা কেউই জানতো না।

এসএসসি পরীক্ষার আগে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় মা আমাকে চিৎকার করে ডাকে, দৌড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে মা? মা বলল: আমার বুকে ব্যথা খুব খারাপ লাগছে।
ভেবেছিলাম জর্দা সাদা পাতা দিয়ে পান খাওয়াতে হয়তোবা বুকে ধরেছে। মুখ থেকে পান ফেলতে বললাম কিন্তু মা ফেলল না।
মা বলল: আমাকে জল এনে দে ?
দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস জল এনে দেই। জল খেয়ে নেয় মা
তারপরও চিৎকার করে বলে আমার বুকে খারাপ লাগছে, আমাকে বেশি করে জল দে না মা?
দৌড়ে টিউবয়েলে চলে যাই ,এক জগ জল এনে গ্লাসে করে খেতে দিতেই, মা বলে জগ আমার হাতে দে?
জগ তুলে দিতেই : ঢক ঢক করে প্রায় একজগ জল খেয়ে নেয় মা। কিন্তু তবুও মায়ের খারাপ লাগা কমেনি এক ফোটাও।সেই সময় ও পৌষ মাসের ২১ তারিখ ছিল।

মাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেই। হাতের তালু পায়ের তালু ধরে দেখি ঠান্ডা তারপর তেল গরম করে মালিশ করতে থাকি
বাজার থেকে বাবাকে ডাক্তার নিয়ে আসতে খবর দেই।
মা আমার হাত টেনে ধরে বলল : অনু মাধুকে তুই দেখিস।
এ কথা শুনে আমরা চার ভাই বোন কাঁদতে শুরু করলাম।

আর মা নারায়ন নারায়ন বলতে বলতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । ডাক্তার নিয়ে আসে বাবা, কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। মা নেই,মা নেই, মা ,,,,
ছোট বোনের বয়স তখন ৫ বছর।
ও শুধু জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে মায়ের?
ও মাকে ডাকছে মা মা উঠোনা।

জীবনের সাথে কাজের লড়াই করি ,এ দিকে বাবার ৫ বছর হয়ে গেছে রিং বসানোর । আমি বড় হয়ে গেছি বলে বাবা
চিকিৎসা করতে যেতে চাইছিলেন না।
আমরা সবাই মিলে বলি কিন্তু বাবা আমাদের কথার গুরুত্ব দেননি ,বাবা বলতেন কিছুই হবে না।
বাবা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, আমাদের কথা শুনে বাবা বলতেন, ভগবান জানে আমি ছাড়া তোমাদের কেউ নেই।
তাই এত চিন্তা করবে না তোমরা।

এ ভাবে যখন সাত বছর হয়ে গেলো একদিন হঠাৎ
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা সেই দিন টি পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন
পাটালী গুড়ের পায়েস রান্না করে ছিলাম।
বাবা কে বললাম একটু পায়েস দেবো বাবা?
বাবা:অল্প করে দিও মা।
বাবা আমার নাম ধরে তেমন ডাকতেন না।
সব সময় মা বলে ডাকতেন।
আমি অসুস্থ হলে জ্বর আসলে? বাবাই মাথা ধুয়ে দিতেন
ঔষধ খাইয়ে দিতেন।
খাবার খাইয়ে দিতেন।
আমার সকল কিছুর পরম অনুপ্রেরণা আমার বাবা।

আর বাবারও ছোট বেলায় মা হারিয়েছেন বলে আমায়
মা ডেকে আত্মতৃপ্তি পেতেন বাবা।
যা বলছিলাম?
দু চামচ পায়েস বাবা মুখে দিলেন। দোতলায় বাবার রুমে গেলেন ঘুমাতে, এদিকে আমি রাতে সবার খাবার শেষে বাসনপত্র পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে রেখেছি।
পরের দিন সকালবেলা পৌষ সংক্রান্তি। ভোরবেলা উঠে সূর্যকে পিঠা দিতে হবে ,উঠানে আলপনা করতে হবে চাউলের গুড়ি দিয়ে। রাত তখন বারোটা কাজ শেষে আমি যখন ঘুমোতে যাবো, বাবা ডাক দিলেন: মা দেখে যা।

বাবার কক্ষে গিয়ে দেখি বাবা ভীষণ রকম কাশছেন।
বাবাকে কাশতে দেখে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি সাথে সাথে বলি আপনার রিং এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বাবা আপনার চিকিৎসাটা পুনরায় করার দরকার ছিল। বাবা বলল আরে না আমার ঠান্ডা লেগেছে তাই কাশি আসছে।
সরিষার তেল গরম করে বাবার বুকে ঘসে দেই,
পায়ের তালুতে ঘষে দেই।
বাবা বললেন গরম জল খাবেন, মাটির উনুন ছিল ঘরের বাইরে ‌। অন্ধকারে ঘরের বাইরে গিয়ে গরম জল করতে ভয় লাগছিল, রাতের আঁধারে খালের ওপারে শেয়াল গুলো খুব জোরে জোরে ডাকছে। তবুও বাবা বলেছে তাই দেরি না করে
মনে মনে জপ করতে করতে গরম জল করে আনি।

বাবা গরম জল খায়।
বাবাকে জিজ্ঞেস করি: এখন কেমন লাগছে বাবা?
বাবা বলল আগের চাইতে একটু ভালো, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পরো মা।
বাবাকে গরম জল দিয়ে, বাকি গরম জল ফ্লাক্সে ঢুকিয়ে বাবার শিয়রে টি টেবিলে রেখে আসি।
তখন রাত ২:৩০ মিনিট। হঠাৎ কাকাদের গোয়াল ঘরের গরু
অদ্ভুত রকম আচরণ করতে লাগলো।
গরুটা ভীষণ জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। বেঁধে রাখা অবস্থায় খুব লাফাতে লাগলো ।
গরুর এমন অবস্থা দেখে মনে মনে আমার ভীষণ ভয় হচ্ছিল
অমনি বাবা আবার ডাকতে শুরু করলেন।
দৌড়ে গেলাম আবার দোতলায়, গিয়ে দেখি বাবার কাশি অনেকটা বেড়ে গেছে, কিন্তু তখনো গরুর চিৎকার থামছে না
কিছুক্ষণ পর উঠোনে দাদার পোষা দুটো কুকুর কান্না করতে লাগলো । পোষ্য প্রাণীদের এমন আত্মচিৎকার দেখে আমার বুকের ভেতরটা মোচোড়দিয়ে উঠলো।
বাবা কে আবার গরম জল দিলাম একটু চা করে দিলাম।
বাবা খেলেন, আর বললেন :আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না মা?
আমি বললাম না বাবা, কিসের কষ্ট।
এভাবে রাত তিনটা বাজলো দাদাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনলাম। আর বললাম একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে দাদা আমার কাকাতো ভাইকে নিয়ে ডাক্তার বাড়িতে ছুটলেন ।
ডাক্তার অরুন দাস পল্লী চিকিৎসক আমাদের গ্রামে তখন তিনি এবং ডাক্তার অতুল দাস (মামা) মানুষের চিকিৎসা করতেন।

ডাক্তার অরুণ দাদুকে নিয়ে ,দাদা আসলো। অরুণ দাদু চেকআপ করে বললেন তেমন সমস্যা না ঠান্ডার সমস্যা ,ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার দাদুর মুখের কথা শুনে স্বস্তি পেলাম।
বাবাকে কিছু ঠান্ডার ঔষধ দিলেন ।
বাবার যখন বারবার কাশি হচ্ছিল তখন আমি একটা তেলের কন্টেইনার কেটে বাবার বালিশের পাশে রাখলাম, থুতু যেন সেই কন্টেইনারে ফেলে। কারণ অতিরিক্ত কাশির কারণে বাবাকে বারবার বিছানা থেকে উঠতে হচ্ছিল ,কন্টেইনারে থুথু ফেললে ,বাবার কষ্ট কম হবে।

ডাক্তার অরুণ দাদুকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন দাদা।
বাবা বললেন এবার সবাই ঘুমাও গিয়ে।
আমি একটি চেয়ার নিয়ে বাবার পাশে বসে রইলাম।
তখন বাবার একটু ঘুম লাগছিলো।
এ ভাবে রাত ৪:৩০ মিনিট। বাবাকে ঘুমোতে দেখে, আমি জানালার পাশে গিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে তাকালাম।
গরুটা তখনো কাঁদছে।
ভগবানের নাম নিলাম বসে বসে।এ ভাবূ ভোর হয়ে এসেছে।
আমি চলে গেলাম পৌষ সংক্রান্তি দিনের সূর্যকে পিঠা দিতে। তখন বাবা আবার ডাক দিলেন।
গিয়ে দেখি বাবার নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। দাদাকে জাগিয়ে বাবার জেঠাতো ভাই ভোলা কাকাকে সহ হাসপাতালে পাঠালাম।
ঘরে অস্থিরতা কমেছিল না।
আমি যেতে চেয়েছি ওরা আমাকে নেয়নি।
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে খবর আসে আমরা সবাই হাসপাতালে যাওয়ার।
হাসপাতালে গেলাম বাবার মুখে অক্সিজেন দেওয়া গায়ের বর্ণ কাঁচা হলুদের মত।
আমাকে বাবা হাতের ইশারায় ডেকেছেন।
কিন্তু বাবাকে বিবর্ণ দেখে আমি সামনে যেতে চাই ছিলাম না।
অজানা ভয় গ্ৰাস করছে ।
আমাদের সাথে জেঠিমা গিয়েছিল হাসপাতালে,
জেঠিমা আমার হাতে ধরে বাবার কাছে নিয়ে যায়
বাবা মাথায় হাত রেখে বলতে চাইছিলো কিছু, কথা গুলো স্পষ্ট ছিল না।

ডাক্তার এসে বললেন রুগিকে ঢাকা রেফার করতে হবে।
শুরু হলো অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার তোড় জোর।
আমি বললাম: আমি ও যাবো। ওরা আমাকে নিলো না।

বাবাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় আর আমরা বাড়িতে রিক্সায় করে আসি।
বাড়িতে এসে মন্দিরে মানত করি বড় করে পূজা করবো
বাবা যদি সুস্থ্য হয়।

কিছুক্ষণ পর বৌদি আসে আমাকে বলে একটু ভাত খা।
আমি বললাম না। বাবা বাড়িতে আসলে খাবো।
বৌদি জোর করে তিন বোনের মুখে ভাত তুলে দিতেই
অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পাই।
অতুল মামা বাবা বন্ধু ছিল।
মামা আমাদের বাড়িতে দরজার সামনে কান্না করছেন
তখনো বুঝিনি বাবা আর নেই।

পুকুরের পাড় থেকে জোরে জোরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে
দাদার আমি দৌড়ে যেতেই সবাই আমাকে ধরে ফেলে।
ঠাকুর ঘরে শুয়ে রাখা হয় বাবাকে।
আমার বাবা গত রাতে ঘুমাতে পারেনি।
এখন কত নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
ওরা বাবার চোখে তুলসী পাতা দিয়েছে আমি তা ফেলে
দিয়েছি। ওদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
ওরা কেউ বোঝে নি।
ওরা কেউ বুঝতে চাইলোই না।
জেগে ওঠার জন্য আমি বাবা কে জল খেতে দিয়েছি,
হাত পা টেনে দিয়েছি কিন্তু বাবা আর সে দিন জাগে নি।
এখন আর বিপদে মানত করি না ‌।
এখন বলি সব তো তোমার ইচ্ছায়।
আমার বলে এখানে কিছুই নেই ‌।
আমার কান্না করার অনুভূতি নেই দাদাকে দেখছি চিৎকার করে কাঁদছে ‌।
আমাদের কার কাছে দিয়ে গেলেন বাবা ‌
ছোট দুই বোন কাঁদতে কাঁদতে নিশ্চুপ হয়ে গেছে ‌।
আর আমি তখন নিজেকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছি , হয়তো আরো যুদ্ধ করতে হবে আমাকে সময়ের সাথে। বাবা মারা যাওয়ার পর চাইলেও হাসতে পারতাম না,হাসির বদলে বুক ভরে
উঠতো নীরবে হারানোর যাতনায়। আগে সব কিছু নিয়ে খুব বেশি দুষ্টামি চঞ্চলতা করতাম বলে সবাই কতইনা আমাকে শাসনে রাখতেন। আর মা বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকটা গম্ভীর যখন হয়ে যাই তখন সবাই কতই চেষ্টা করতো একটু হাসাতে ,দৈবেরবান বড়ই কঠিন
তাই রয়েছে হৃদয় মলিন,
তাই পুড়িয়েছি সুখ শান্তি
জীবন গড়েছি মমতা বিহীন।

বাবা আজ পৌষ সংক্রান্তি ।