ঢাকা ০৮:১২ পিএম, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নুরুল ইসলাম নূরচান’র ছোটগল্প : সৈকত

  • আপডেট সময় : ১২:২৮:০০ এএম, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ৭২৮

 

ভাদ্র মাস। প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে।

এমনিতেই তাল পাকা গরম। তার ওপর বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে অস্থির মানুষ।

এখন দুপুর দুটো বাজে। সকাল থেকে এক ফোঁটা বাতাসও নেই, ঘেমেনেইয়ে একাকার হয়ে গেছে বাসাবাড়ি এমনকি অফিস পাড়ার মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় আইপিএসেও কুলাচ্ছে না।

হলুদ রঙের দোতলা ভবন। নিচতলায় বসে কাজ করছিল কয়েকজন। এরই মধ্যে দ্রুত গতিতে এক যুবক এসে হাজির। তার চোখে মুখে অজানা শঙ্কা।

‘স্যার আমারে মাইরেন না। আমি একটা হাছা কথা কই। আগে আমারে গ্রেফতার করেন!’

দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা বললেন,
: তোকে গ্রেফতার করবো কেন, আর মারবোই বা কেন?
: আগে আমারে গ্রেফতার করেন, তারপর সব কইতাছি।
: আগে বল তুই কি অপরাধ করেছিস?
: অটোরিক্সা চালক আরমানকে আমি খুন করছি। তার খুনের আমিই প্রধান।

গত এক সপ্তাহ আগে চালককে খুন করে অটোরিক্সা ছিনতাই করে নিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। এরপর থানায় মামলা হয়। মামলা হওয়ার পর থেকে পুলিশ এই ঘটনার রহস্য খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। এই হত্যাকাণ্ড কে ঘটিয়েছে, কে রিক্সা ছিনতাই করেছে? তার কোন হদিস খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ।

থানায় এসে খুনি আত্মসমর্পণ করার পর একেবারে যেন সোনায় সোহাগা। খোঁজখবর নিয়ে তারপর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল। এবং আদালতে পাঠালো। আদালতে পাঠানোর পর তার বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ড দাবি করে। অবশেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশ যুবককে থানায় রিমান্ডে নিয়ে আসেন। এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।

: তোর নাম কী?
: সৈকত।
: বয়স কত?
: বাইশ বছর।
: লেখাপড়া করেছিস?
: হ।
: কী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিস?
: আইএ পাস করেছিলাম, পরে বাঁদরামি করার কারণে আর পড়া হয়ে ওঠেনি।
: এই পথ বেছে নিলি কেন?
: বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে প্রথমে একটু একটু নেশা করেছি। পরে আস্তে আস্তে পুরো নেশাখোর হয়ে গেছি।
: বিয়ে করেছিস, ছেলেমেয়ে আছে?
: না বিয়ে করিনি। বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি হয় না।
: চাকরি-বাকরি নিলি না কেন?
: নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও চাকরি হয়নি, সরকারি চাকরির জন্য একজনের সাথে কথা হয়েছিল। সে জানালো ১০ লাখ টাকার কম চাকরি দিতে পারবেনা। অসরকারি চাকরিও তেমন ভালো পাইনি। এদিকে আমাকে নিয়ে আমার পরিবার খুবই দুশ্চিন্তায় আছে। এটা আমি বুঝি। কিন্তু করার কিছুই নেই, কোন কাজে মন বসে না।
: আরমানকে খুন করেছিলে কেন?
: আমিসহ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে মদগাঞ্জা খাই। টাকা পয়সার অভাবে পড়লেই চুরি ছিনতাই করি আমরা। অভাব মানে মদ গাঞ্জার টাকা না থাকলে। সেদিন মদ গাঞ্জা খাওয়ার জন্য খুবই পিপাসা লেগেছিল। কিন্তু আমাদের কারো কাছে টাকা পয়সা ছিল না। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, অটোরিকশা ছিনতাই করব। এদিন শেষ বিকেলেই আরমানকে ভাড়ার কথা বলে আমরা তিনজন তার অটোরিক্সায় উঠি।

: তুই ছাড়া বাকি আর দুজন কে কে?
: রফিকুল ও সজীব।
: তারা এখন কোথায় আছে?
: কই আছে সেটা বলতে পারবো না।
: তাদের মোবাইল নাম্বারে ফোন দে!
: আমার মোবাইল নেই, তাছাড়া তাদের মোবাইল নম্বরও আমার মুখস্ত নাই।
: তোর মোবাইল ফোন কী হয়েছে?
: খুনের ঘটনার পর বাটন মোবাইলের সিম খুলে নদীতে ফেলে দিয়েছি।
: এটা করলি কেন?
: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে আমাকে ধরতে না পারে সেজন্য।
: তো শেষ পর্যন্ত এসে তুই তো ধরা দিলি, ইচ্ছে করে এসে ধরা দিলি কেন?
: বিবেকের তাড়নায়। কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না। যেখানে যাই সেখানেই শুধু আরমানের মুখের ছবিটা ভেসে ওঠে, খুব অস্থিরতা লাগে,এজন্য একদিন প্রশান্তির আশায় গাঙ্গে কচুরিপানার ভেতর গলাঅবদি ডুবিয়ে পানিতে বসে ছিলাম। তারপরও শান্তি পাইনি। শেষ পর্যন্ত থানায় চলে এসেছি। আমার ফাঁসির ব্যবস্থা করেন।

‘এটাতো আদালতের ব্যাপার। ফাঁসি হবে না যাবজ্জীবন দণ্ড হবে- নির্ধারণ করবেন আদালত।’ পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠ। পরে তিনি উৎসাহ নিয়ে বললেন, তুই খুব ভালো কাজ করেছিস, না হলে আমাদের হয়রানি আরো অনেক বেড়ে যেত।’

দ্বিতীয় দিনের রিমান্ড :

দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন
: তোর জীবনে কয়টা খুন করেছস?
: আরমানকে ছাড়া আর একটাও না।
: অটোরিকশা ছিনতাই করেছস কয়টা?
: কম করে হলেও দশ বারোটা।
: তো তাদেরকে খুন করিসনি কেন?
: আমাদের সুবিধা মতো জায়গায় নিয়ে চাপ প্রয়োগ করার পর রিক্সা দিয়ে দিয়েছেন তারা, তাই খুনখারাবি করতে হয়নি,,, আরমানকেও বলেছিলাম, কিন্তু সে রাজি হয়নি, আমাদের সাথে জবরদস্তি করেছে। তাই রাগের মাথায়—-
: হুঁ বুঝতে পারছি।

 

রচনাকাল : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নুরুল ইসলাম নূরচান’র ছোটগল্প : সৈকত

আপডেট সময় : ১২:২৮:০০ এএম, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

ভাদ্র মাস। প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে।

এমনিতেই তাল পাকা গরম। তার ওপর বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে অস্থির মানুষ।

এখন দুপুর দুটো বাজে। সকাল থেকে এক ফোঁটা বাতাসও নেই, ঘেমেনেইয়ে একাকার হয়ে গেছে বাসাবাড়ি এমনকি অফিস পাড়ার মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় আইপিএসেও কুলাচ্ছে না।

হলুদ রঙের দোতলা ভবন। নিচতলায় বসে কাজ করছিল কয়েকজন। এরই মধ্যে দ্রুত গতিতে এক যুবক এসে হাজির। তার চোখে মুখে অজানা শঙ্কা।

‘স্যার আমারে মাইরেন না। আমি একটা হাছা কথা কই। আগে আমারে গ্রেফতার করেন!’

দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা বললেন,
: তোকে গ্রেফতার করবো কেন, আর মারবোই বা কেন?
: আগে আমারে গ্রেফতার করেন, তারপর সব কইতাছি।
: আগে বল তুই কি অপরাধ করেছিস?
: অটোরিক্সা চালক আরমানকে আমি খুন করছি। তার খুনের আমিই প্রধান।

গত এক সপ্তাহ আগে চালককে খুন করে অটোরিক্সা ছিনতাই করে নিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। এরপর থানায় মামলা হয়। মামলা হওয়ার পর থেকে পুলিশ এই ঘটনার রহস্য খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। এই হত্যাকাণ্ড কে ঘটিয়েছে, কে রিক্সা ছিনতাই করেছে? তার কোন হদিস খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ।

থানায় এসে খুনি আত্মসমর্পণ করার পর একেবারে যেন সোনায় সোহাগা। খোঁজখবর নিয়ে তারপর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল। এবং আদালতে পাঠালো। আদালতে পাঠানোর পর তার বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ড দাবি করে। অবশেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশ যুবককে থানায় রিমান্ডে নিয়ে আসেন। এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।

: তোর নাম কী?
: সৈকত।
: বয়স কত?
: বাইশ বছর।
: লেখাপড়া করেছিস?
: হ।
: কী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিস?
: আইএ পাস করেছিলাম, পরে বাঁদরামি করার কারণে আর পড়া হয়ে ওঠেনি।
: এই পথ বেছে নিলি কেন?
: বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে প্রথমে একটু একটু নেশা করেছি। পরে আস্তে আস্তে পুরো নেশাখোর হয়ে গেছি।
: বিয়ে করেছিস, ছেলেমেয়ে আছে?
: না বিয়ে করিনি। বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি হয় না।
: চাকরি-বাকরি নিলি না কেন?
: নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও চাকরি হয়নি, সরকারি চাকরির জন্য একজনের সাথে কথা হয়েছিল। সে জানালো ১০ লাখ টাকার কম চাকরি দিতে পারবেনা। অসরকারি চাকরিও তেমন ভালো পাইনি। এদিকে আমাকে নিয়ে আমার পরিবার খুবই দুশ্চিন্তায় আছে। এটা আমি বুঝি। কিন্তু করার কিছুই নেই, কোন কাজে মন বসে না।
: আরমানকে খুন করেছিলে কেন?
: আমিসহ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে মদগাঞ্জা খাই। টাকা পয়সার অভাবে পড়লেই চুরি ছিনতাই করি আমরা। অভাব মানে মদ গাঞ্জার টাকা না থাকলে। সেদিন মদ গাঞ্জা খাওয়ার জন্য খুবই পিপাসা লেগেছিল। কিন্তু আমাদের কারো কাছে টাকা পয়সা ছিল না। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, অটোরিকশা ছিনতাই করব। এদিন শেষ বিকেলেই আরমানকে ভাড়ার কথা বলে আমরা তিনজন তার অটোরিক্সায় উঠি।

: তুই ছাড়া বাকি আর দুজন কে কে?
: রফিকুল ও সজীব।
: তারা এখন কোথায় আছে?
: কই আছে সেটা বলতে পারবো না।
: তাদের মোবাইল নাম্বারে ফোন দে!
: আমার মোবাইল নেই, তাছাড়া তাদের মোবাইল নম্বরও আমার মুখস্ত নাই।
: তোর মোবাইল ফোন কী হয়েছে?
: খুনের ঘটনার পর বাটন মোবাইলের সিম খুলে নদীতে ফেলে দিয়েছি।
: এটা করলি কেন?
: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে আমাকে ধরতে না পারে সেজন্য।
: তো শেষ পর্যন্ত এসে তুই তো ধরা দিলি, ইচ্ছে করে এসে ধরা দিলি কেন?
: বিবেকের তাড়নায়। কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না। যেখানে যাই সেখানেই শুধু আরমানের মুখের ছবিটা ভেসে ওঠে, খুব অস্থিরতা লাগে,এজন্য একদিন প্রশান্তির আশায় গাঙ্গে কচুরিপানার ভেতর গলাঅবদি ডুবিয়ে পানিতে বসে ছিলাম। তারপরও শান্তি পাইনি। শেষ পর্যন্ত থানায় চলে এসেছি। আমার ফাঁসির ব্যবস্থা করেন।

‘এটাতো আদালতের ব্যাপার। ফাঁসি হবে না যাবজ্জীবন দণ্ড হবে- নির্ধারণ করবেন আদালত।’ পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠ। পরে তিনি উৎসাহ নিয়ে বললেন, তুই খুব ভালো কাজ করেছিস, না হলে আমাদের হয়রানি আরো অনেক বেড়ে যেত।’

দ্বিতীয় দিনের রিমান্ড :

দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন
: তোর জীবনে কয়টা খুন করেছস?
: আরমানকে ছাড়া আর একটাও না।
: অটোরিকশা ছিনতাই করেছস কয়টা?
: কম করে হলেও দশ বারোটা।
: তো তাদেরকে খুন করিসনি কেন?
: আমাদের সুবিধা মতো জায়গায় নিয়ে চাপ প্রয়োগ করার পর রিক্সা দিয়ে দিয়েছেন তারা, তাই খুনখারাবি করতে হয়নি,,, আরমানকেও বলেছিলাম, কিন্তু সে রাজি হয়নি, আমাদের সাথে জবরদস্তি করেছে। তাই রাগের মাথায়—-
: হুঁ বুঝতে পারছি।

 

রচনাকাল : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪