ঢাকা ০৪:২৫ পিএম, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পেটে ক্ষুধা, মনেও : হোসাইন মোশারফ

  • আপডেট সময় : ০৯:১৬:১৭ পিএম, শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৪
  • ৮৯২

একটা থালা ভাত দিবি মা? পান্তা পচা।
সাথে দু’টো শুকনা মরিচ তেলে ভাজা?
থাক মা রে থাক, তেল পাবি কই?
তারচে বরং জ্বলা ছাইয়ে চাপা দিয়েই
দে পুড়িয়ে, ঝালতো একই,
স্বাদ কি আবার, পেট ভরা চাই।
তাও নেই, না?
চিন্তা নেই মা,
ভাত দে আমি শেখের খেতের ডাঁসা কটা
মোটা তাজা নিয়ে আসি মরিচ কাঁচা।
চুরিই করি, তাতে কি মা?
মরলে চলবে? লাগবে বাচাঁ।
এ কিরে মা ভাত চেয়েছি পান্তা পচা
কাঁদিস কেন? তাও নেই, তাই নারে মা?
তাই বলে তুই কাঁদবি নাকি।
তুই এত বোকা কেন?
বলতে পারিস;
‘ভাত নাই রে বাপ যা
গাছের কচি পাতা খা।
সকাল গেল, দুপুর গেল রাতেও না হয়।
জানিস রে মা, ভাতের কথা মুখে নিলে
খিদে বাড়ে, বাড়লে খিদে
শান্তি তাও পাতা গিলে।
আমি কি আর জানি না মা
ভাত আজ, কাল আর পাবো না।
আমি কি আর বুঝি না মা
আমায় ছাড়া তুই খাবি না
তাই তো আমি এত্তোগুলা আমড়া পাতা
নরম নরম কচি কচি
নিয়ে এলাম তুই আমি মা….
‘কিরে মামুন কি করছিস? ঘুমাবি না। এত রাতে কি লিখতেছিস? রিফাত হুট করেই ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করতেই কলমের নিচের কাগজটা লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পরে মামুন। রিফাত দেখে ফেললে লজ্জা। কত লজ্জা! এক লজ্জা কবিতা লেখার আরেক লজ্জা এমন বুভুক্ষু কবিতার।
লজ্জায় লাল হয়ে কাগজটা একটা বইয়ের নিচে রেখে দিল মামুন। রিফাত মানবে কেন? লুকায়িত বিষয়ে আকর্ষণ বেশি তাই রিফাত কাগজটি প্রায় জোর করে বের করে পড়তে থাকে। মাথা নিচু করে বসে আছে মামুন।
রিফাতের সামনে এমনিতেই লজ্জায় লজ্জায় থাকে আর আজ পড়েছে ধরা। পড়া শেষে রিফাত চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।

রিফাত মামুনকে খুব পছন্দ করে। অতিমাত্রায় পছন্দ। মামুন কবিতা লিখতে পারে এই ব্যাপারটা ছাড়া মামুনের সব বিষয়ই রিফাতের গোচরে আছে। মামুন কেন এমন একটা দুর্ভিক্ষময় কবিতা লিখলো কারণ খুজছে মনে মনে।
‘কিরে তুই কবিতা লিখতে পারিস জানতাম নাতো’ এমন প্রশ্নে চুপ করে থাকে মামুন। ‘আরো আছে? এবার মামুন ‘আরে না ভাই আর নাই’ মামুনের অতি সাবধানতায় রিফাতের সন্দেহ হয়। এদিক সেদিক খোজাখুজি শুরু করে।

মামুন খুব উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করে যেন না পায় এমন ভান ধরে কিন্তু মনে মনে ইশারা করে ভাই বিছানাটা উঠান। কারণ এই প্রথম কেউ একজন কবিতা পরে বলেছে ‘দারুণ হয়েছে তোর কবিতা, আরো আছে?

মামুনের কবিতার কথা আর একজনই মাত্র জানতো সে শুধু বলতো কবিতায় চুলা জ্বলে না। তাই তার মন জ্বলতো রাগে।

মাসের ১৩ তারিখ আজ। মেসের টাকা জমা না দেয়ায় খাবার বন্ধ করে দিয়েছে সকাল থেকে। কয়েকটা বিস্কিট ছিল আর কটা চিড়া তা খেয়েই সকালে বেড়িয়েছিল মামুন। সারাদিন কিছু খায় নি। গত মাসের ২১ তারিখ জুতা কারখানার চাকরিটা চলে যাওয়ার সময় এক মাস একুশ দিনের টাকা পায় মামুন।

প্রতিদিন যায় কারখানায়, টাকা পায় না। কালকে এসো, পরশু এসো এই অবস্থা। হাতে পায়ে ধরা বাকি আছে, কাল এইটাও করবে মামুন। খেতে হবে, বাঁচতে হবে তো।
মাসের বেতনের প্রায় সবটাই তো পাঠিয়ে দেয় মাকে গ্রামে। ছোট ভাই আর মায়ের কি হয় পাঁচ হাজার টাকায়? তাও ভাল বউ চলে গেছে রাগ করে, নয়ত এতেও হত না কিছুই। এক হাজার দেয় মেসের খরচ। তাও বিশেষ বিবেচনায়। রিফাতের ক্ষমতায়। তিনশ থাকে পকেট খরচ। চা পান ধুমপান কিছুই করে না মামুন। খাওয়ার মধ্যে বিস্কিট আর চিড়া।

তিনশতেই বেশ চলে যায় বেশ। চাকরিটা চলে গিয়ে বিপদে পরেছে মামুন। সামনের মাসে বাড়িতে কি পাঠাবে নিজেই বা কি খাবে? নতুন চাকরি তাও হচ্ছে না।

এইদিকে রিফাত খুজতে খুজতে বিছানার নিচে এক কাব্যখনি আবিস্কার করে ফেলে। উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখে আর অবাক হয়। এই ছেলে করেছে কি? এত কিছু কবে লিখলো? আর জানালো না কেন? রতন ভাই তাইলে ঠিকই বলেছে, বলেছে ছেলে সারাদিন কই ধ্যান ধরে বসে থাকে কাজে তার মন কই? রিফাত গিয়েছিল কয়দিন আগে কারখানায় চাকরি গেল কেন জানতে। রতন রিফাতের পরিচিত। রিফাতই মামুনকে রতনের কাছে পাঠিয়ে ছিল চাকরির জন্য।

– তোর এত এত কবিতা আছে তুই আমাকে জানাস নি কেন? কয়দিন আগে বইমেলা গেল। এখানে যা দেখছি তাতে একটা বড়সড় কাব্য গ্রন্থ ছাপানো যেতো।
– আরে নাহ ভাই। এইগুলো কোন কবিতা হলো?
– যা খেয়ে আয়। খেয়ে ঘুম দে আমি দেখি কালই তোর বইয়ের কাজে হাত দিব? আজ রিফাত মামুনের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে এসেছে সপিং মলে মোবাইলের দোকানে। কিন্তু মনস্থির করলো পাঠাবে না। এই ছেলে শুধু লিখবে। বিক্রি না হলে ফেরি করে বই বিক্রি করবে রিফাত। মনস্থির, পাকা মনস্থির।
– এখন যা খেতে যা। রিফাতের জবাবে আমতা আমতা করে মামুন বললো ‘
– ভাই মিল বন্ধ।

রিফাত জানে মামুনের মিল সকাল থেকে বন্ধ। একটু আগে খেতে গিয়ে নোটিসে দেখেছে। মেস ম্যানেজার কে খুব কড়া ভাষায় শাসিয়ে টাকা দিয়ে মিল চালু করে দিয়েছে। কাল সকাল থেকে খেতে পারবে মামুন। নিজে না খেয়ে দুইজনে রিফাতের রাতের খাবার খাবে তাই মামুনকে ডাকতে এসেছে রিফাত। রিফাত জানে সারাদিন কিছুই খায়নি মামুন। কিন্তু এখন নিজের আর খেতে ইচ্ছে করছে না। মামুনই খাক। একবার না খেলে রিফাতদের কিছু না হলেও মামুনদের অনেক কিছুই হয়। পেটের ক্ষুদায় গরিবের কলিজা গলে যায় আর ধনীর গলে চর্বি। তাই রিফাত মিথ্যে বলল মামুনকে, বলল ‘আমি খেয়ে আসছি, তুই আমার খাবার খেয়ে নে গিয়ে যা। আর মেসের টাকা আমি দিয়ে দিয়েছি, কাল থেকে তোর খাবার কেউ বন্ধ করতে পারবে না। এই মাসেতো না ই কোন মাসেই না। রিফাতের কথা শুনে মামুন আবেগ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ক্ষুধার্ত পেটে বিবেক মরে গেলেও আবেগ হয় তাজা। কথা বললেই আবেগ ধরা পড়বে কাপা গলায়, তাই কিছু বললো না। ঝাপ্সা চোখে খেতে চলে যাচ্ছিল রিফাত বললো কবিতাটা কি এইখানেই শেষ নাকি আরো বড় হবে?
যেতে যেতে মামুন বললো ‘ভাই একটু আগে পর্যন্ত এখানেই শেষ ছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরো দুটো লাইন লাগবে। আগে খেয়ে আসি পরে লিখব।

রিফাত বিছানার নিচে অযত্নে পরে থাকা কবিতার পাতাগুলো যত্ন করে গোছাতে থাকে। প্রতিজ্ঞা করে মনে মনে মামুনের জীবনটাও গুছিয়ে দেয়ার। এই দুটাকার বিছানার নিচে কত মুল্যবান রত্ন লুকিয়ে রেখে তার উপর ঘুমিয়ে থাকতো মামুন। কি বিচিত্র এই জগত, কত বিচিত্র জগতের মামুনগুলো।

মামুন নির্লজ্জ চিত্তে পেটপুরে খেয়ে আরাম করে রিফাতের পাশে বসে বলতে লাগলো কবিতার পরের লাইনগুলো।
একি মাসি এত রাতে তুমি কেন?
এ মা একি? ভাত এনেছো? দাও মাসি মা
খাব এবার আমি মায়ে দুজন মিলে,
গিলে গিলে।

এ মা, দেখনা মাগো ইলিশ ভাজা
সাথে মরিচ তেলে ভাঁজা।
মাসি তুমি এত্তো ভালো?
দাও মাসি মা, দোয়া তোমায়, প্রানের দোয়া
এবার বুঝি মুক্তি এলো, এবার বুঝি দুঃখ গেল।
লেখাটা শেষ করে রিফাতের হাতে এগিয়ে দিল কাগজটা। এরই মধ্যে লজ্জা গেছে কেটে।
রিফাত হোতে নিয়ে বাকি কবিতাটা পড়লো মনোযোগ দিয়ে।

– ভাই ভাল হয়েছে?
– হুম। খুব ভাল তবে ঠিক যেখানে শেষ করেছিলি খাওয়ার আগে সেখানে কি যেন আরো লাগতো।
– ভাই ভুল হয়েছে খাওয়ার আগে লিখে গেলে এই ভুলটা হত না। প্রেমে পড়লে প্রেমের কবিতা বিচ্ছেদে বিরহের, তেমনি ক্ষুধার্ত পেটে ক্ষুদার কবিতা ভরাটা পেটে তৃপ্তির। পেট মস্তিককে প্রভাবিত করে আর মস্তিস্ক প্রভাবিত করে মনকে আর মন থেকে আসে কবিতা। এখন ঘুমাই বলেই মামুন চিত হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। নিমিষেই গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো মামুন। এত তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমাতে পারে? মামুনের ঘুমন্ত চেহারায় শ্রান্তির ছাপ। আর এই দৃশ্যে রিফাত আপ্লুত। এতটুকু প্রাপ্তিতে এত শান্তি? একবেলা ভাতের এত শক্তি?

রিফাত চুপ করে বসে রইল মামুনের পাশে। নিজে না ঘুমিয়ে এমন একটা ঘুমের সাক্ষি হতে পারায় এত আত্মতৃপ্ত হওয়া যায় রিফাত আগে জানতো না। রিফাত আজ ঘুমাবে না, সারারাত ঘুমন্ত মামুনকে দেখবে।

রিফাতের হাতে মামুনের শখানেক কবিতা । কিছুক্ষণ আগেও কেবলই দুঃস্বপ্ন ছিল মামুনের মামুনের মতই কবিতাদেরও, এখন ছাপাখানার অপেক্ষা।

পেটে ক্ষুধা, মনেও : হোসাইন মোশারফ

আপডেট সময় : ০৯:১৬:১৭ পিএম, শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৪

একটা থালা ভাত দিবি মা? পান্তা পচা।
সাথে দু’টো শুকনা মরিচ তেলে ভাজা?
থাক মা রে থাক, তেল পাবি কই?
তারচে বরং জ্বলা ছাইয়ে চাপা দিয়েই
দে পুড়িয়ে, ঝালতো একই,
স্বাদ কি আবার, পেট ভরা চাই।
তাও নেই, না?
চিন্তা নেই মা,
ভাত দে আমি শেখের খেতের ডাঁসা কটা
মোটা তাজা নিয়ে আসি মরিচ কাঁচা।
চুরিই করি, তাতে কি মা?
মরলে চলবে? লাগবে বাচাঁ।
এ কিরে মা ভাত চেয়েছি পান্তা পচা
কাঁদিস কেন? তাও নেই, তাই নারে মা?
তাই বলে তুই কাঁদবি নাকি।
তুই এত বোকা কেন?
বলতে পারিস;
‘ভাত নাই রে বাপ যা
গাছের কচি পাতা খা।
সকাল গেল, দুপুর গেল রাতেও না হয়।
জানিস রে মা, ভাতের কথা মুখে নিলে
খিদে বাড়ে, বাড়লে খিদে
শান্তি তাও পাতা গিলে।
আমি কি আর জানি না মা
ভাত আজ, কাল আর পাবো না।
আমি কি আর বুঝি না মা
আমায় ছাড়া তুই খাবি না
তাই তো আমি এত্তোগুলা আমড়া পাতা
নরম নরম কচি কচি
নিয়ে এলাম তুই আমি মা….
‘কিরে মামুন কি করছিস? ঘুমাবি না। এত রাতে কি লিখতেছিস? রিফাত হুট করেই ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করতেই কলমের নিচের কাগজটা লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পরে মামুন। রিফাত দেখে ফেললে লজ্জা। কত লজ্জা! এক লজ্জা কবিতা লেখার আরেক লজ্জা এমন বুভুক্ষু কবিতার।
লজ্জায় লাল হয়ে কাগজটা একটা বইয়ের নিচে রেখে দিল মামুন। রিফাত মানবে কেন? লুকায়িত বিষয়ে আকর্ষণ বেশি তাই রিফাত কাগজটি প্রায় জোর করে বের করে পড়তে থাকে। মাথা নিচু করে বসে আছে মামুন।
রিফাতের সামনে এমনিতেই লজ্জায় লজ্জায় থাকে আর আজ পড়েছে ধরা। পড়া শেষে রিফাত চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।

রিফাত মামুনকে খুব পছন্দ করে। অতিমাত্রায় পছন্দ। মামুন কবিতা লিখতে পারে এই ব্যাপারটা ছাড়া মামুনের সব বিষয়ই রিফাতের গোচরে আছে। মামুন কেন এমন একটা দুর্ভিক্ষময় কবিতা লিখলো কারণ খুজছে মনে মনে।
‘কিরে তুই কবিতা লিখতে পারিস জানতাম নাতো’ এমন প্রশ্নে চুপ করে থাকে মামুন। ‘আরো আছে? এবার মামুন ‘আরে না ভাই আর নাই’ মামুনের অতি সাবধানতায় রিফাতের সন্দেহ হয়। এদিক সেদিক খোজাখুজি শুরু করে।

মামুন খুব উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করে যেন না পায় এমন ভান ধরে কিন্তু মনে মনে ইশারা করে ভাই বিছানাটা উঠান। কারণ এই প্রথম কেউ একজন কবিতা পরে বলেছে ‘দারুণ হয়েছে তোর কবিতা, আরো আছে?

মামুনের কবিতার কথা আর একজনই মাত্র জানতো সে শুধু বলতো কবিতায় চুলা জ্বলে না। তাই তার মন জ্বলতো রাগে।

মাসের ১৩ তারিখ আজ। মেসের টাকা জমা না দেয়ায় খাবার বন্ধ করে দিয়েছে সকাল থেকে। কয়েকটা বিস্কিট ছিল আর কটা চিড়া তা খেয়েই সকালে বেড়িয়েছিল মামুন। সারাদিন কিছু খায় নি। গত মাসের ২১ তারিখ জুতা কারখানার চাকরিটা চলে যাওয়ার সময় এক মাস একুশ দিনের টাকা পায় মামুন।

প্রতিদিন যায় কারখানায়, টাকা পায় না। কালকে এসো, পরশু এসো এই অবস্থা। হাতে পায়ে ধরা বাকি আছে, কাল এইটাও করবে মামুন। খেতে হবে, বাঁচতে হবে তো।
মাসের বেতনের প্রায় সবটাই তো পাঠিয়ে দেয় মাকে গ্রামে। ছোট ভাই আর মায়ের কি হয় পাঁচ হাজার টাকায়? তাও ভাল বউ চলে গেছে রাগ করে, নয়ত এতেও হত না কিছুই। এক হাজার দেয় মেসের খরচ। তাও বিশেষ বিবেচনায়। রিফাতের ক্ষমতায়। তিনশ থাকে পকেট খরচ। চা পান ধুমপান কিছুই করে না মামুন। খাওয়ার মধ্যে বিস্কিট আর চিড়া।

তিনশতেই বেশ চলে যায় বেশ। চাকরিটা চলে গিয়ে বিপদে পরেছে মামুন। সামনের মাসে বাড়িতে কি পাঠাবে নিজেই বা কি খাবে? নতুন চাকরি তাও হচ্ছে না।

এইদিকে রিফাত খুজতে খুজতে বিছানার নিচে এক কাব্যখনি আবিস্কার করে ফেলে। উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখে আর অবাক হয়। এই ছেলে করেছে কি? এত কিছু কবে লিখলো? আর জানালো না কেন? রতন ভাই তাইলে ঠিকই বলেছে, বলেছে ছেলে সারাদিন কই ধ্যান ধরে বসে থাকে কাজে তার মন কই? রিফাত গিয়েছিল কয়দিন আগে কারখানায় চাকরি গেল কেন জানতে। রতন রিফাতের পরিচিত। রিফাতই মামুনকে রতনের কাছে পাঠিয়ে ছিল চাকরির জন্য।

– তোর এত এত কবিতা আছে তুই আমাকে জানাস নি কেন? কয়দিন আগে বইমেলা গেল। এখানে যা দেখছি তাতে একটা বড়সড় কাব্য গ্রন্থ ছাপানো যেতো।
– আরে নাহ ভাই। এইগুলো কোন কবিতা হলো?
– যা খেয়ে আয়। খেয়ে ঘুম দে আমি দেখি কালই তোর বইয়ের কাজে হাত দিব? আজ রিফাত মামুনের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে এসেছে সপিং মলে মোবাইলের দোকানে। কিন্তু মনস্থির করলো পাঠাবে না। এই ছেলে শুধু লিখবে। বিক্রি না হলে ফেরি করে বই বিক্রি করবে রিফাত। মনস্থির, পাকা মনস্থির।
– এখন যা খেতে যা। রিফাতের জবাবে আমতা আমতা করে মামুন বললো ‘
– ভাই মিল বন্ধ।

রিফাত জানে মামুনের মিল সকাল থেকে বন্ধ। একটু আগে খেতে গিয়ে নোটিসে দেখেছে। মেস ম্যানেজার কে খুব কড়া ভাষায় শাসিয়ে টাকা দিয়ে মিল চালু করে দিয়েছে। কাল সকাল থেকে খেতে পারবে মামুন। নিজে না খেয়ে দুইজনে রিফাতের রাতের খাবার খাবে তাই মামুনকে ডাকতে এসেছে রিফাত। রিফাত জানে সারাদিন কিছুই খায়নি মামুন। কিন্তু এখন নিজের আর খেতে ইচ্ছে করছে না। মামুনই খাক। একবার না খেলে রিফাতদের কিছু না হলেও মামুনদের অনেক কিছুই হয়। পেটের ক্ষুদায় গরিবের কলিজা গলে যায় আর ধনীর গলে চর্বি। তাই রিফাত মিথ্যে বলল মামুনকে, বলল ‘আমি খেয়ে আসছি, তুই আমার খাবার খেয়ে নে গিয়ে যা। আর মেসের টাকা আমি দিয়ে দিয়েছি, কাল থেকে তোর খাবার কেউ বন্ধ করতে পারবে না। এই মাসেতো না ই কোন মাসেই না। রিফাতের কথা শুনে মামুন আবেগ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ক্ষুধার্ত পেটে বিবেক মরে গেলেও আবেগ হয় তাজা। কথা বললেই আবেগ ধরা পড়বে কাপা গলায়, তাই কিছু বললো না। ঝাপ্সা চোখে খেতে চলে যাচ্ছিল রিফাত বললো কবিতাটা কি এইখানেই শেষ নাকি আরো বড় হবে?
যেতে যেতে মামুন বললো ‘ভাই একটু আগে পর্যন্ত এখানেই শেষ ছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরো দুটো লাইন লাগবে। আগে খেয়ে আসি পরে লিখব।

রিফাত বিছানার নিচে অযত্নে পরে থাকা কবিতার পাতাগুলো যত্ন করে গোছাতে থাকে। প্রতিজ্ঞা করে মনে মনে মামুনের জীবনটাও গুছিয়ে দেয়ার। এই দুটাকার বিছানার নিচে কত মুল্যবান রত্ন লুকিয়ে রেখে তার উপর ঘুমিয়ে থাকতো মামুন। কি বিচিত্র এই জগত, কত বিচিত্র জগতের মামুনগুলো।

মামুন নির্লজ্জ চিত্তে পেটপুরে খেয়ে আরাম করে রিফাতের পাশে বসে বলতে লাগলো কবিতার পরের লাইনগুলো।
একি মাসি এত রাতে তুমি কেন?
এ মা একি? ভাত এনেছো? দাও মাসি মা
খাব এবার আমি মায়ে দুজন মিলে,
গিলে গিলে।

এ মা, দেখনা মাগো ইলিশ ভাজা
সাথে মরিচ তেলে ভাঁজা।
মাসি তুমি এত্তো ভালো?
দাও মাসি মা, দোয়া তোমায়, প্রানের দোয়া
এবার বুঝি মুক্তি এলো, এবার বুঝি দুঃখ গেল।
লেখাটা শেষ করে রিফাতের হাতে এগিয়ে দিল কাগজটা। এরই মধ্যে লজ্জা গেছে কেটে।
রিফাত হোতে নিয়ে বাকি কবিতাটা পড়লো মনোযোগ দিয়ে।

– ভাই ভাল হয়েছে?
– হুম। খুব ভাল তবে ঠিক যেখানে শেষ করেছিলি খাওয়ার আগে সেখানে কি যেন আরো লাগতো।
– ভাই ভুল হয়েছে খাওয়ার আগে লিখে গেলে এই ভুলটা হত না। প্রেমে পড়লে প্রেমের কবিতা বিচ্ছেদে বিরহের, তেমনি ক্ষুধার্ত পেটে ক্ষুদার কবিতা ভরাটা পেটে তৃপ্তির। পেট মস্তিককে প্রভাবিত করে আর মস্তিস্ক প্রভাবিত করে মনকে আর মন থেকে আসে কবিতা। এখন ঘুমাই বলেই মামুন চিত হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। নিমিষেই গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো মামুন। এত তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমাতে পারে? মামুনের ঘুমন্ত চেহারায় শ্রান্তির ছাপ। আর এই দৃশ্যে রিফাত আপ্লুত। এতটুকু প্রাপ্তিতে এত শান্তি? একবেলা ভাতের এত শক্তি?

রিফাত চুপ করে বসে রইল মামুনের পাশে। নিজে না ঘুমিয়ে এমন একটা ঘুমের সাক্ষি হতে পারায় এত আত্মতৃপ্ত হওয়া যায় রিফাত আগে জানতো না। রিফাত আজ ঘুমাবে না, সারারাত ঘুমন্ত মামুনকে দেখবে।

রিফাতের হাতে মামুনের শখানেক কবিতা । কিছুক্ষণ আগেও কেবলই দুঃস্বপ্ন ছিল মামুনের মামুনের মতই কবিতাদেরও, এখন ছাপাখানার অপেক্ষা।