
বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো।তিনি আরও বলেন,ধন বল,আয়ু বল,অন্যমনস্ক ব্যক্তির ছাতা বল,সংসারে যত কিছু মরণশীল পদার্থ আছে বই হচ্ছে সকলের সেরা।সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ আর সাহিত্যের দর্পণ হচ্ছে বই বা গ্রন্থ।বই হচ্ছে সকলের পরম বন্ধু, অতি নিকটতম আপনজন।সকল জ্ঞানের এক মহাভান্ডার।
বই পড়ে যে জ্ঞান আহরণ করা যায় অন্যকিছুতে তা সম্ভব নয়।বই পড়ে যে শুধু মানুষের জ্ঞানই বৃদ্ধি পায় তা কিন্তু নয়,বই মানুষকে একাকীত্বে সঙ্গ দেয়,আনন্দ দেয় ও মনের সকল অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে। বই পড়ে মানুষ নম্র-ভদ্র হয়,চরিত্রবান হয় ও ধনী-গরিব সকলের সাথে উত্তম আচরণ করতে শেখে।এছাড়া বই পড়ে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ,শালীনতা, শিষ্টাচার, সততা,সত্যবাদীতা,সময়নিষ্ঠা,চেতনাবোধ ইত্যাদি জাগ্রত হয়।বই পড়েই মানুষ বিদ্যাসাগর হয়েছেন, বিশ্বে যত জ্ঞানীগুণী মনীষী, বৈজ্ঞানিক ও খ্যাতমান যত ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন বা গত হয়েছেন তারা সকলে বই পড়েই বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হয়েছেন। বইয়ের এই সকল বিশদ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিশেষজ্ঞগণ প্রতিবছর একবার বইমেলার আয়োজনে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বিশ্বের সকল দেশেই বইমেলা বা গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়।বইমেলা বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এর জন্ম হয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে।ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে স্টুরব্রিজের মেলা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলার বইয়ের অংশের নাম ছিল ‘বুক সেলার্স রো’।ম্যাথু কেরীর উদ্যোগে ১৮০২ সালে সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে পূর্ণাঙ্গ বইমেলার আয়োজন করা হয়। বইয়ের একক উপস্থিতিতে ১৯২৪ সালে লিপজিগের বইমেলার আয়োজন হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বইমেলার পর্যায়ক্রমিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
১৯৪৯ সালে ফ্রাংকফুটে বইমেলার সূচনা হয়। এরপর থেকে সারাবিশ্বে বইমেলা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জার্মানির লিপজিগ বা ফ্রাংকফুট ছাড়াও লন্ডন, সিঙ্গাপুর, কায়রো,প্যারিস,টোকিও,কলকাতা প্রভৃতি বইমেলাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশের বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের পুরনো নয়।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিকে বাঙালি জাতির মানসে চির জাগরূক রাখার প্রয়াসে প্রথম বইমেলার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে তা একুশে বইমেলা নামে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে পুরো ফেব্রুয়ারী মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে ‘ঢাকা বইমেলা’।
১লা জানুয়ারি থেকে পনেরো দিনের এই মেলায় দেশে বিশিষ্ট লেখকগণ অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বার্ষিক বইমেলার আয়োজন করে।আবার দেশের বিভিন্ন জেলা,থানায় বিভিন্ন সময়ে বইমেলার আয়োজন করে থাকে। ব্যক্তি,সমাজ তথা জাতীয় জীবনে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বইমেলার মাধ্যমে নতুন নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং আমরা নিত্য নতুন জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হই।বইমেলায় শুধু দেশি লেখকদের বই-ই নয়,বিদেশি লেখকদের বইও পাওয়া যায়।
এতে করে বিশ্বের নানা জ্ঞানী ও পন্ডিত ব্যক্তির চিন্তাচেতনা,অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, দর্শন-ভাবনা ইত্যাদির সাথে পরিচিতি লাভ করা যায়। তাই কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয়-
হেথায় মিশেছে দিশি দিশি হতে, বিপুল জ্ঞানের ধারা,
শত মনীষীর চিন্তার বাণী,আনন্দে আকুল পারা।
বইমেলা লেখক ও পাঠক এই দুয়ের মধ্যাকার সম্পর্ক জোরদার করে।যারা কর্মব্যস্ততার চাপে বই কেনার সময় পান না,বইমেলা পরিবারের সকলের সাথে মেলায় গিয়ে আনন্দ করা ও বই কেনার সেই সুযোগ করে দেয়।বইমেলার সুন্দর ও মনোরম পরিবেশ পাঠকদের বই পাঠের প্রতি উৎসাহ ও আগ্রহ বৃদ্ধি করে এবং কবি ও সাহিত্যিকদের নব উদ্যমে সম্মুখে পথ চলার নবপ্রেরণা জোগায়। বইমেলায় বই কেনাবেচার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক আয় হয়।
এছাড়া প্রকাশনীগুলোতে এসময় বেশি বেশি বই তৈরি করার অর্ডার পায়,এতে করে তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হয়।বইমেলা হচ্ছে বাঙালীর জাতীয় জীবনের একটি সংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও একটি অনন্য উৎসব।তাই বইমেলার প্রতি আমাদের সকলের আন্তরিক হতে হবে।কেননা বই মানুষের রুচি ও আদর্শের উন্নয়ণ ঘটায়, মানুষকে জ্ঞান দানের মাধ্যমে মহৎ ও মহীয়ান করে তুলে।আর মহৎ,জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষই জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধ করে।প্রবাদে আছে,যে জাতি যত শিক্ষিত,সে জাতি তত উন্নত। অতএব শিক্ষা,সংস্কৃতির প্রসারে বইমেলার অবদান এবং ব্যক্তি,সমাজ ও জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে আমাদের সকলের উচিৎ বইমেলাকে স্বাগত জানানো।