
পলাশ ভাই হাসপাতালের সিটে শুয়ে কি যেন হিসেব করছে। কাগজে কলমে না, হিসেব করছে মনে মনে।
আমি পাশের খালি সিটটায় বসা। সরকারী হাসপাতালে মানুষ জন কম আসে কেন বুঝি না। সরকারী হাহাসপাতালে খরচাপাতি কম জেনেও আমাদের মত গরিব দেশের মানুষজন সব প্রাউভেট হাসপাতালে দৌড়ায়। বোকা মানুষের বোকা দেশ।
পলাশ ভাইয়ের উপরে ইয়াহিয়া খান আমলের একটা ফ্যান। স্থীর হয়ে দাড়িয়ে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে পলাশ ভাই। মাঝে মাঝে মাথা নাড়াচ্ছে, ডান হাতের তর্জনী উঠানামা করছে।
চোখেমুখে রাগের ছাপ। ভ্রুকুচকানো। দাতে দাত চেপে খিচ মেরে আছে। সামনে যাকে পাবে পানি ছাড়া গিলে খাবে এমন অবস্থা।
এই আবার মনে হচ্ছে কাঁদো কাঁদো। দুনিয়ার সবচেয়ে নরম মনের মানুষ উনি সামনে যাকে পাবে তাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদবে।
আমি পলাশ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি অপেক্ষায়, কখন উনার হিসাব-নিকাশ শেষ হবে। দুটো কথা বলবো। একা একা কথাবার্তা ছাড়া বসে থাকতে কেমন পাহারাদার পাহারাদার লাগে। আমি উঠে পলাশ ভাইয়ের কাছে গেলাম। কপালে হাত রাখলাম।
একি! গা তো পুড়ে যাচ্ছে! জ্বর কম করে হলেও একশো উনপঞ্চাশ। আমার মাথা আউলায়ে গেল। ডাক্তার ডাকতে হবে, দিলাম দৌড়। জরুরী বিভাগে খোজ নিতে গিয়ে মেজাজটাই গেল খারাপ হয়ে। দায়িত্বে যিনি আছেন উনাকে চার পাচ বার বলার পরে উনি কান থেকে মোবাইল নামিয়ে মোটামুটি ধমকের সুরে বললো ‘আপনি যান আমি আসছি। ডিউটি ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও নেই। রাত তো খুব বেশি না। এগারোটার কাছাকাছি। হাসপাতালের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাত তিনটা বাজে।
– ভাই আজ বুঝলাম সরকারী হাসপাতালে রোগী কেন কম আসে। কাপতে কাপতে পলাশ ভাই বললো ‘তোর আইডি লগ আউট করে আমার আইডি লগ কর।
পলাশ ভাই বলল আর আমি স্ট্যাটাস লিখলাম
‘আমি পলাশ। লোকে আমাকে ঠেঙ্গা পলাশ ডাকে। ঠেঙ্গা পলাশ ডাকে কারণ আমি কারণে অকারণে ঠেঙ্গাই। আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছি, অথচ হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোন খোজ খবর নেয়া হচ্ছে না। বেঁচে থাকলে
ঠেঙ্গাবো। আপনারা তখন কিছু বলতে পারবেন না’
বিরক্তি নিয়ে স্ট্যাটাসটা পোস্ট করে আমি আবার জরুরী বিভাগে যাচ্ছি। হায় কপাল উনি এখনো দাত কেলিয়ে কথা বলেই যাচ্ছেন। মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। মন চাচ্ছিলো কানের নিচে একটা বসিয়ে দেই। কিন্তু দিলাম না। আবারো ভদ্র ভাবে বললাম ‘ভাই ফোনের উপাশে যিনি আছেন উনি কি প্রধানমন্ত্রী? নাকি একটু পরে মারা যাবেন?
উনি রেগেমেগে একাকার। আমাকে কিছু বলতে যাবেন এমন সময় ল্যান্ডফোনে একটা কল আসে। কথাবার্তায় যতটুকু বুঝলাম উনি ফাপড়ে পড়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি আমাকে ইশারা করে সোজা দৌড়। এক দৌড়ে পলাশ ভাইয়ের পাশে।
খাতির যত্ন গেল শুরু হয়ে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা হাজির। হাজির হয়েই ধমকাধমকি শুরু করলেন। এতক্ষনে হাসপাতালের যত স্ট্যাফ আছে সবাই হাজির।
পলাশ ভাইকে ইনজেকশন, স্যালাইন, ঔষধ সব দেয়া হলো। দশ মিনিট যেতে না যেতেই পলাশ ভাইয়ের জ্বর নেমে আসে। বিশ মিনিটের মধ্যে এলাহী সব কান্ডকারখানা ঘটতে থাকলো হাসপাতালে।
পলাশ ভাইয়ের রাজনৈতিক গুরু আমাদের শিল্পমন্ত্রী ইকবাল হায়দার মাহমুদ, থানার ওসি কায়কোবাদ, উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিস পাটোয়ারী সহ আরো বিশ পঁচিশ জন হাজির। ইতোমধ্যে ডিউটি ডাক্তার মাহবুব তালুকদার আর জরুরী বিভাগের নিজাম উদ্দিন বরখাস্ত।উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তার হাটুকাপাকাপি শুরু।
আমি এখন ওয়ার্ডের এক কোনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছি। পলাশ ভাই উঠে বসছে। তাকে ঘীরে আছে সব ভি আই পি। পলাশ ভাইকেও ভি আই পি মনে হচ্ছে। এমন বোকাকেল্লা ঘাড়ত্যাড়া একটা মানুষের জন্য এতগুলো ভি আই পি মানুষের এভাবে উপস্থিতি আমাকে সত্যি অবাক করলো।
আমি অযথাই ভাইটার নাম দিছিলাম ঠেঙ্গা পলাশ, নাম দেয়া উচিত ছিল…. । নাহ মাথায় এখন কোন নাম আসছে না। নিজেকে চুনুপুটি মনে হচ্ছে। লজ্জা লজ্জা লাগছে এই ভেবে পলাশ ভাইকে আমি তাচ্ছিল্যই করি সব সময়। অথচ কতটা দামি মানুষ আমার পলাশ ভাই। আমাদের ঠেঙ্গা পলাশ (ভাই)।