ঢাকা ০৪:২২ পিএম, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ছোটগল্প।। ইজ্জত আলীর জীবনগাথা

  • আপডেট সময় : ০৭:২২:২৬ পিএম, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০২৩
  • ১১৬১

নূরুল ইসলাম নূরচান

বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস থামার পর ইজ্জত আলী বাস থেকে দ্রুত নেমে পড়েছেন। বাস থেকে নেমে লোকজনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে খুব সাবধানে অনেক দূর চলে গেলেন সে। এর মধ্যে একবারও ডান বাঁ কিংবা পেছন ফিরে তাকায়নি। তার মধ্যে বড় রকমের একটা ভয় কাজ করছিল। তাই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল।

তাকে এলাকার মানুষ ভালো মানুষ হিসেবেই জানে। সে গিয়ে বসল একটি চায়ের দোকানে। অনেকক্ষণ যাবৎ সে চা পান করেনি, তাই চায়ের খুব পিপাসা লেগেছে তার। দোকানে অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি ছেলে চা বানাচ্ছে। ছেলেটাকে ডেকে এক কাপ রং চা’র অর্ডার করলো সে। দোকানের বেঞ্চে বসে দৈনিক পত্রিকাটির হেডলাইনে চোখ বুলাচ্ছে ইজ্জত আলী আর মনে মনে ভাবছে, ওই লোকটি যদি তাকে দেখে ফেলে এবং এখানে চলে আসে তখন সে কী করবে?

এসব ভাবনার মধ্যেই চা রেডি করে তার সামনে রেখে দিয়ে চা’র ছেলেটি বলল, ‘কাহা আফনের চা।’
‘আইচ্ছা, এনো থো’- বলে ইজ্জত আলী চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে চুমুক দিতে যাবে অমনি চোখে পড়ল চা’র উপর একটা মাছি। এটা পিচ্চিকে জানোর পর সে কাপটি নিয়ে গিয়ে চা ফেলে দিল। এবং পুনরায় আরেকটি চা বানিয়ে এনে দিল। তিনি এক ঢোক চা মুখে জানল, চিনি কম হয়েছে। নরম স্বরে বললেন, ‘আমার ডায়াবেটিস নাই- আরেকটু চিনি দে।’

‘কমই খাইন, দাম অনেক বেশি, খালি বাড়তাছে চিনির দাম’- বলে পিচ্চি একটু চিনি এনে দিল।

ইজ্জত আলী চা পান করছে। এসময় একটি ছেলে দোকানে ঢুকল। তার বয়স অনুমান ১৮-১৯ বছর হবে। ছেলেটিকে দেখে ইজ্জত আলী ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির সেকী ভাবসাব! মাথাভর্তি চুলে ডিঙি নৌকা কাটিং, ভ্রু, গোঁফ এবং দাড়িতেও আছে নানা রকম ফ্যাশন। এক কাপ মালাই চা পান করে সে বিদায় নেয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ইজ্জত আলী। প্রথমে সে মনে করেছিল, তার কোন ক্ষতি করার জন্য ছেলেটি এখানে প্রবেশ করেছে।

ইজ্জত আলী ওই ছেলেকে নিয়ে খানিক ভাবলো, ‘কেমন পরিবারের সন্তান হলে চুল, দাড়ি এবং গোঁফে এ ধরনের ফ্যাশান করতে পারে! কেমন মা-বাবার সন্তান রে তুই?’

কিন্তু তার মনে ভয়ের রেশ এখনো কাটেনি। সে দ্রুত চা পান করে দাম চুকিয়ে এখান থেকে পুনরায় দ্রুত চলে গেল অন্য আরেক জায়গায়। সেখানে গিয়ে নিরিবিলি একটি চা দোকানে বসল। কিন্তু কোনমতেই স্বস্তি পাচ্ছে না, তার মনে একটিই ভয়, যদি ওই লোকটি চলে আসে, তখন কী জবাব দেবে?

ইজ্জত আলীর দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্ত্রী গত হয়ে গেছেন পাঁচ বছর আগে। এতদিন মেয়েটাই তাকে রান্নাবান্না করে খাইয়েছেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এক বছর হয়।

বিয়ের পর মেয়ে চলে গেছে তার স্বামীর বাড়িতে। দুই ছেলে বউ নিয়ে দূরে থাকেন কর্মসূত্রে। তাই তাকে রান্নাবান্না করে দেয়ার মত আর কেউ নেই। ফলে নিজের খাবার নিজেরই রেঁধে খেতে হয় তার। মাঝেমধ্যে রুটি কলা খেয়ে সময় পার করেন।

শেষ বয়সের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য কয়েকবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন সে। অবশ্য তার স্ত্রী মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ‘আমি মরে গেলে আপনে আর বিয়া কইরেন না, এতে পোলাপানের কষ্ট অইব।’ সেও তখন কথা দিয়েছিলেন, সে আর বিয়ে করবে না। কিন্তু মানুষের মন বলে কথা। জীবিত মানুষের কথাই মানুষ মনে রাখে না, আর তার বউ তো মারাই গিয়েছেন। তবে বউয়ের কথা মনে পড়লে মাঝেমধ্যে কষ্ট হয় তার।

অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ছেলেমেয়েরা এতে মত দেন না। যদি দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান সন্ততি হয়ে যায় তাহলে তাদের সম্পদে ভাগ বসাবে। এসব চিন্তা মাথায় আসার কারণেই ছেলেমেয়েরা রাজি হন না তাদের বাবা আবার দ্বিতীয় বিয়ে করুক। ছেলেমেয়েদের মানার কারণে ইজ্জত আলী পড়েছেন মহা বিপাকে। একদিকে তার শারীরিক চাহিদা তো আছেই, তার ওপর আবার ‘হাত পুড়ে ভাত রেঁধে’ খেতে হয়। মাঝেমধ্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান সে।

ইজ্জত আলীর লুকোচুরি খেলার কথা বলি। সে যে বাসে চড়ে এসেছেন তার ২০ টাকা ভাড়া সে দেয়নি, মেরে দিয়েছে। বাসের কন্ডাকটর কয়েকবার ভাড়া চেয়েছেন। কিন্তু সে ‘দেম দিচ্ছি’ করে আর দেননি। পরে স্টেশনে বাস থামার পর দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়েন। বাসের কন্ডাকটরের ভয়েই সে অনেকক্ষণ যাবৎ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। এর আগেও কয়েকবার ঢাকা গিয়েছেন ট্রেনে চেপে। তখনো ট্রেনের টিকিট কাটেননি। এর জন্য একবার ঝামেলায় পড়েছিলেন। পরে ট্রেনের এক কর্মচারীকে কিছু টাকা দিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন সে।

তবে ইজ্জত আলীর একটি গুণ আছে। শহর বন্দরে গেলে অসহায় কোন মানুষ হাত পাতলে তাকে কমপক্ষে পাঁচ দশ টাকা দিয়ে বিদায় করেন। কেউ তার কাছে হাত পাতলে তার মন মোমের মত গলে যায়। আপন মনে তখন বলে, ‘আহা বেচারা, এ জীবন কেন বেছে নিলি!’

ছোটগল্প।। ইজ্জত আলীর জীবনগাথা

আপডেট সময় : ০৭:২২:২৬ পিএম, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০২৩

নূরুল ইসলাম নূরচান

বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস থামার পর ইজ্জত আলী বাস থেকে দ্রুত নেমে পড়েছেন। বাস থেকে নেমে লোকজনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে খুব সাবধানে অনেক দূর চলে গেলেন সে। এর মধ্যে একবারও ডান বাঁ কিংবা পেছন ফিরে তাকায়নি। তার মধ্যে বড় রকমের একটা ভয় কাজ করছিল। তাই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল।

তাকে এলাকার মানুষ ভালো মানুষ হিসেবেই জানে। সে গিয়ে বসল একটি চায়ের দোকানে। অনেকক্ষণ যাবৎ সে চা পান করেনি, তাই চায়ের খুব পিপাসা লেগেছে তার। দোকানে অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি ছেলে চা বানাচ্ছে। ছেলেটাকে ডেকে এক কাপ রং চা’র অর্ডার করলো সে। দোকানের বেঞ্চে বসে দৈনিক পত্রিকাটির হেডলাইনে চোখ বুলাচ্ছে ইজ্জত আলী আর মনে মনে ভাবছে, ওই লোকটি যদি তাকে দেখে ফেলে এবং এখানে চলে আসে তখন সে কী করবে?

এসব ভাবনার মধ্যেই চা রেডি করে তার সামনে রেখে দিয়ে চা’র ছেলেটি বলল, ‘কাহা আফনের চা।’
‘আইচ্ছা, এনো থো’- বলে ইজ্জত আলী চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে চুমুক দিতে যাবে অমনি চোখে পড়ল চা’র উপর একটা মাছি। এটা পিচ্চিকে জানোর পর সে কাপটি নিয়ে গিয়ে চা ফেলে দিল। এবং পুনরায় আরেকটি চা বানিয়ে এনে দিল। তিনি এক ঢোক চা মুখে জানল, চিনি কম হয়েছে। নরম স্বরে বললেন, ‘আমার ডায়াবেটিস নাই- আরেকটু চিনি দে।’

‘কমই খাইন, দাম অনেক বেশি, খালি বাড়তাছে চিনির দাম’- বলে পিচ্চি একটু চিনি এনে দিল।

ইজ্জত আলী চা পান করছে। এসময় একটি ছেলে দোকানে ঢুকল। তার বয়স অনুমান ১৮-১৯ বছর হবে। ছেলেটিকে দেখে ইজ্জত আলী ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির সেকী ভাবসাব! মাথাভর্তি চুলে ডিঙি নৌকা কাটিং, ভ্রু, গোঁফ এবং দাড়িতেও আছে নানা রকম ফ্যাশন। এক কাপ মালাই চা পান করে সে বিদায় নেয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ইজ্জত আলী। প্রথমে সে মনে করেছিল, তার কোন ক্ষতি করার জন্য ছেলেটি এখানে প্রবেশ করেছে।

ইজ্জত আলী ওই ছেলেকে নিয়ে খানিক ভাবলো, ‘কেমন পরিবারের সন্তান হলে চুল, দাড়ি এবং গোঁফে এ ধরনের ফ্যাশান করতে পারে! কেমন মা-বাবার সন্তান রে তুই?’

কিন্তু তার মনে ভয়ের রেশ এখনো কাটেনি। সে দ্রুত চা পান করে দাম চুকিয়ে এখান থেকে পুনরায় দ্রুত চলে গেল অন্য আরেক জায়গায়। সেখানে গিয়ে নিরিবিলি একটি চা দোকানে বসল। কিন্তু কোনমতেই স্বস্তি পাচ্ছে না, তার মনে একটিই ভয়, যদি ওই লোকটি চলে আসে, তখন কী জবাব দেবে?

ইজ্জত আলীর দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্ত্রী গত হয়ে গেছেন পাঁচ বছর আগে। এতদিন মেয়েটাই তাকে রান্নাবান্না করে খাইয়েছেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এক বছর হয়।

বিয়ের পর মেয়ে চলে গেছে তার স্বামীর বাড়িতে। দুই ছেলে বউ নিয়ে দূরে থাকেন কর্মসূত্রে। তাই তাকে রান্নাবান্না করে দেয়ার মত আর কেউ নেই। ফলে নিজের খাবার নিজেরই রেঁধে খেতে হয় তার। মাঝেমধ্যে রুটি কলা খেয়ে সময় পার করেন।

শেষ বয়সের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য কয়েকবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন সে। অবশ্য তার স্ত্রী মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ‘আমি মরে গেলে আপনে আর বিয়া কইরেন না, এতে পোলাপানের কষ্ট অইব।’ সেও তখন কথা দিয়েছিলেন, সে আর বিয়ে করবে না। কিন্তু মানুষের মন বলে কথা। জীবিত মানুষের কথাই মানুষ মনে রাখে না, আর তার বউ তো মারাই গিয়েছেন। তবে বউয়ের কথা মনে পড়লে মাঝেমধ্যে কষ্ট হয় তার।

অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ছেলেমেয়েরা এতে মত দেন না। যদি দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান সন্ততি হয়ে যায় তাহলে তাদের সম্পদে ভাগ বসাবে। এসব চিন্তা মাথায় আসার কারণেই ছেলেমেয়েরা রাজি হন না তাদের বাবা আবার দ্বিতীয় বিয়ে করুক। ছেলেমেয়েদের মানার কারণে ইজ্জত আলী পড়েছেন মহা বিপাকে। একদিকে তার শারীরিক চাহিদা তো আছেই, তার ওপর আবার ‘হাত পুড়ে ভাত রেঁধে’ খেতে হয়। মাঝেমধ্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান সে।

ইজ্জত আলীর লুকোচুরি খেলার কথা বলি। সে যে বাসে চড়ে এসেছেন তার ২০ টাকা ভাড়া সে দেয়নি, মেরে দিয়েছে। বাসের কন্ডাকটর কয়েকবার ভাড়া চেয়েছেন। কিন্তু সে ‘দেম দিচ্ছি’ করে আর দেননি। পরে স্টেশনে বাস থামার পর দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়েন। বাসের কন্ডাকটরের ভয়েই সে অনেকক্ষণ যাবৎ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। এর আগেও কয়েকবার ঢাকা গিয়েছেন ট্রেনে চেপে। তখনো ট্রেনের টিকিট কাটেননি। এর জন্য একবার ঝামেলায় পড়েছিলেন। পরে ট্রেনের এক কর্মচারীকে কিছু টাকা দিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন সে।

তবে ইজ্জত আলীর একটি গুণ আছে। শহর বন্দরে গেলে অসহায় কোন মানুষ হাত পাতলে তাকে কমপক্ষে পাঁচ দশ টাকা দিয়ে বিদায় করেন। কেউ তার কাছে হাত পাতলে তার মন মোমের মত গলে যায়। আপন মনে তখন বলে, ‘আহা বেচারা, এ জীবন কেন বেছে নিলি!’