শাশুড়ি প্রায় সময় খোঁটা দেয় আমিনাকে। বলে, 'তোর বাবার বাড়ি না অনেক বড়লোক। তোর বাবা মাকে বলতে পারোস না কিছু টাকা-পয়সা আমাদেরকে দেওয়ার জন্য। তবেই তো তোর এত কষ্ট করতে হয় না। আসলে তোর বাবা মা এত কিপটে কেন?'
শাশুড়ির কথার কোন উত্তর দেয় না আমিনা। নীরবে চোখের জল ফেলে। তাছাড়া শাশুড়ির কথার প্রতিত্তোর দিতে গেলে আবার বলে, 'মুখে মুখে তর্ক করিস কেন!' সে এও জানে, শাশুড়িরকে কোনভাবেই বুঝাতে পারবে না যে তার বাবা-মা কতটা কষ্টে চলে। তার বিয়ের সময় পঞ্চাশ জন বরযাত্রীকে আপ্যায়ন করাসহ প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই খরচের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তার বাবার ফসলি জমিটুকু বন্ধক দিতে হয়েছে। এখন ভাগে বরগায় ফসল ফলিয়ে তা দিয়ে সংসার চলছে তাদের।
নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। এরপর আর পড়াশোনা করা হয়নি। নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় কাতার প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয় তার। মোবাইল ফোনে বিয়ে। স্বামী অবৈধভাবে থাকত ওখানে। বিয়ের দু-তিন মাস পর পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে দেশে ফেরত এলো বেচারা। আগে টাকা পয়সা তেমন রোজগার করতে পারেনি। বলতে গেলে শূন্য হাতেই দেশে ফিরে এসেছে। দেশে এসে একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালানোর আয় দিয়ে সংসার মোটামুটি ভালই চলছিল। একদিন রাতে যাত্রীবেশী কয়েকজন ছিনতাইকারী আকবর আলীর রিকশাটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের সংসারে অভাব অনটন বাসা বাঁধে।
আমিনা নয় মাসের গর্ভবতী। এখন ভালো কিছু খাওয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু সংসারে 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা। ঠিক মত তিনবেলা ভাতই জোটে না তার। তাছাড়া গর্ভকালীন রোগ শোকে কাতর সে। ঠিকমত খানাপিনার অভাবে ওর শরীরটা লিকলিকে হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন যাবত তার উঁচু পেটটা ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। স্বামী আকবর আলী তার স্ত্রীকে নিয়ে আফসোস করে। বলে, 'তোমার অপরিপক্ক শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল বয়ে গেছে, আমি ঠিকমত তোমার যত্ন নিতে পারি না।'
আমিনা বলে, 'তাতে কী! আপনি তো আমার স্বামী। মা-বাবা আউস করে আপনার লগে আমাকে বিয়া দিছে, স্বামীর খেদমত করে মরে গেলেও সুখ আছে।'
একদিন হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমিনা। এ খবর পাঠানো হয়েছে তার বাবার বাড়িতে। বাবার বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আমিনার পক্ষের লোকজনকে জানানো যে, 'পানি শুকিয়ে গেছে, দ্রুত সিজার করতে হবে। নইলে বাচ্চা এবং মা দুজনই মারা যাবে।'
আমিনার পক্ষের লোকজনের অনুমতি সাপেক্ষে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। ওখানে যাওয়ার সময় ওর দু'চোখের জল মুছে দিলেন তার বাবা। বললেন, 'মা রে কাঁদিস না, আল্লাহকে ডাক, দোয়া দরুদ পড়।'
ঘণ্টাখানেক পর ট্রলিতে চাপিয়ে আমিনাকে নিয়ে এলো দুজন নার্স। তার সারা শরীর সাদা কাফনে ঢাকা। একজন নার্স করুণ কণ্ঠে বললেন, 'কাউকে-ই বাঁচানো গেল না!'
রচনাকাল : ১১ জুন ২০২৪
সম্পাদক ঃ নূরুল ইসলাম নুরচান
মোবাইল ঃ ০১৭১৫-৩৬৩৩১৬
ইমেইল ঃ somoyerkheya@gmail.com
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সময়ের খেয়া