প্রিন্ট এর তারিখঃ এপ্রিল ১৯, ২০২৫, ৭:৫৩ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ৯, ২০২৪, ১০:৪১ পি.এম
কবিতার বিষয়বস্তু অনুসন্ধান ও শামসুর রাহমানের কবিতা
তুহিন ওয়াদুদ
কবিতা সাহিত্যের অপরাপর আঙ্গিকের চেয়ে সূক্ষ্ম। পরিমিতিবোধের নিবিড় পরিচর্যায় কবিতা গড়ে ওঠে। অনেক সময় বিষয় গৌণ হয়ে দেখা দেয় বিনির্মাণকৌশলের কাছে। কবিচিত্তের ভাবকাঠামো শব্দগত রূপ লাভ করলেই কবিতার মর্যাদায় উন্নীত হয় না।
এর জন্য কবিতার অনুগামী প্রকাশ জরুরি। আবার অন্যের আদলে কবিতার বিনির্মাণ হলেও অনুকরণের দায়ে কবিপ্রতিভা বিশেষত্ব লাভ করে না। এসব দিক বিবেচনায় শামসুর রাহমান কবিতা বিনির্মাণে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। শুধু স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা নয়, তাঁর কবিতা বিনির্মাণকৌশল বিস্তর গবেষণার দাবি রাখে।
কবিতা কোনো বিষয়ের প্রতিবেদন রচনা নয়; বরং পরোক্ষ ভঙ্গি কবিতার গভীরে বিষয়ের আঙিনায় প্রবেশে অনেকটাই আচ্ছাদন তৈরি করে। ফলে কবির চিন্তাপ্রসূত বিষয়ের স্বরূপ পাঠকের কাছে অবিকৃত অবস্থায় না-ও পৌঁছতে পারে। কবির চিন্তাঘনিষ্ঠ মূল বিষয়ের পরিপার্শ্ব দিয়ে পাঠক হাঁটাচলাও করতে পারেন। এমনও হতে পারে, পাঠক কোনো কবিতা পড়ে ভালো লাগার অনুভূতিতে উদ্বেলিত হতে পারেন।
কিন্তু কবি যে বিষয় নিয়ে লিখেছেন, পাঠক সেই বিষয় থেকে অনেক দূরের কোনো বিষয় ওই কবিতা থেকে আবিষ্কার করতে পারেন। কবিতার বিষয় নিয়ে এত বিচিত্র মাত্রার রহস্য থাকলেও আমরা পাঠক কবিতার বিষয় অনুসন্ধানী হয়ে উঠি। কারণ কবিতার আঙ্গিকের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার বিষয়ও আমাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে।শামসুর রাহমানের কবিতার বিষয় অনুসন্ধান কখনো কখনো সহজসাধ্য। তবে সব সময় নয়।
তাঁর যেসব কবিতার বিষয়রহস্য উন্মোচন গভীর অনুধ্যান দাবি করে, সেগুলোর শিল্পমান যেমন উচ্চ পর্যায়ের, তেমনি সহজবোধ্য বিষয়সম্পন্ন কবিতার শিল্পমূল্যও শিল্পমান-উত্তীর্ণ।শামসুর রাহমানের ‘রুপালি স্নান’ কবিতাটি এক উচ্চমার্গীয় শিল্পের স্তরে ওঠার শক্তি নিয়ে গড়ে উঠেছে। কবিকে ভাব-কল্পনার স্তরে নিজেকেই উপজীব্য হতে দেখি। নিজের কবিতা চর্চার কথা এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাঁর নিজের কবিতা চর্চার প্রসঙ্গ কোথাও সুনির্দিষ্ট বয়ানে বিন্যস্ত হয়নি। পাঠককে কবিতার গভীর থেকে তুলে আনতে হয় বিষয়টি। তবে পাঠক যদি কবিতার গভীর থেকে বিষয় তুলে আনতে ব্যর্থও হন, তবু কবিতা পাঠ ক্লান্তি এনে দেবে না। কারণ কবিতায় যে শব্দের খেলা, স্তবকে স্তবকে যে অবয়ব দাঁড় করানো, সেখানেও থাকে শিল্পের বিবিধ সৌন্দর্য। শামসুর রাহমানের এ কবিতাও অনুরূপ।‘রুপালি স্নান’ কবিতার শুরুতে আমরা দেখি, ‘দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ’ প্রসঙ্গ। কবি ক্রমান্বয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় পৌঁছেছেন। কবিচিত্ত অবগাহন করে মেঠো চাঁদে। যে চাঁদ ‘লিখে রেখে যায়/কোনো গভীর পাঁচালি।’ সময়ের বর্ণনায় নিজেকে আবিষ্কার করার প্রত্যয়ে হাজার যুগের তারাময় আকাশের বর্ণনায় নিমজ্জিত হন কবি। তিনি কবিদের প্রতি কিছু মানুষের মন্তব্য তুলে ধরেন—‘চোখ ঠেরে কেউ চলে যায় দূরে, কেউ সুনিপুণ গভীর হেলায়/মোমের মতন চকচকে সুখী মুখ তুলে বলে এঁকেবেঁকে ‘ইশ,/দিনরাত্তির মধুভুক সেজে পদ্য বানায় ওহো, কী রাবিশ!’ কবি এসবের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। সব প্রতিকূলতার মধ্যে কবি আপন ভুবনে হয়ে যান ‘সম্রাট’।হাজার বছরের বর্ণনা, প্রকৃতি, সাধারণদের ভাষ্য শেষে কবির কল্পনা ফিরে আসে সমকালীন সংক্ষুব্ধ সময়ে। যখন কবি এ কবিতা লেখেন, তখন পৈশাচিকতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতায়। কবি শামসুর রাহমান এ পাকিস্তানের আগ্রাসী সরকারের রোষানল থেকে নিজেকে আলাদা ভাবেননি। বরং তিনি রোষানলের সব বিভীষিকার সামনে দাঁড়াতেই প্রস্তুত। ‘দু’টুকরো রুটি/না পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক-গা ঘুমে বিবর্ণ’ হন কবি। ‘হিংস্র নেকড়ের পাল’ হয়তো কবিকে হত্যা করবে। তবু অনড় তিনি। কবি সুখ খুঁজেছেন, স্বস্তি খুঁজেছেন সাহসী উচ্চারণে। তিনি লিখেছেন—‘হয়তো কখনো আমার ঠাণ্ডা মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ/শহরের কোন নর্দমাতেই;—সেখানে নোংরা পিছল জলের/অগুনতি ঢেউ/খাব কিছুকাল। যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি/প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবু শান্ত রুপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।’শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় বিষয়কে শব্দ-বাক্য-পঙিক্তর আড়ালে রেখে দেন। একেকটি শব্দ, একেকটি বাক্যের সূত্র ধরে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে প্রবেশ করতে হয়। যাঁরা শুধু কবিতায় দগদগে বিষয় সন্ধান করেন, তাঁদের অনেকের কাছে শামসুর রাহমানের সব কবিতা ভালো লাগবে না। কবির এমন অনেক কবিতাও আছে, যেগুলো বিষয়ের প্রখরতায় সব পরোক্ষ ভঙ্গিকে অতিক্রম করেছে। কবিতার জন্য পরোক্ষাশ্রয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কবিতাশিল্পের জন্য এ এক অমোঘ বাণীরূপ। তবে সর্বৈব নয়। উদাহরণ হিসেবে শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতাটির কথা বলা যায়। আমরা জানি, যখনই কবি-শিল্পী বিষয়ের তাড়নায় কবিতা সৃষ্টিতে প্রয়াসী হন, তখনই তাঁর পরোক্ষাশ্রয়ী ব্যঞ্জনা থাকে না। সেই ব্যঞ্জনা ছাড়া কবিতা কত শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা বিভিন্ন সময়ে পরখ করেছি। কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অনেক কবিতায় সেই সত্যই আলো দিয়েছে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ শামসুর রাহমানের পতাকাবাহী কবিতা। সামাজিক দায়বদ্ধতার এক পরমতম প্রকাশ এ কবিতা। পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর সীমাহীন অবিচারে রুষ্ট ছিলেন কবি। প্রতিটি মুহূর্ত দিয়ে তিনি তা উপলব্ধি করেছেন। ফলে সর্বসাধারণের চেয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বেশি ছিল কবির।পাকিস্তানি রাজনীতির ক্লেদ সম্পর্কে অবগত কবি আবেগের স্বাধীনতা দিয়ে দেশবোধে উজ্জীবিত বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। তার মধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতা একটি। বিষয়ের ওপর শব্দের খেলা এখানে অনুপস্থিত। শব্দে শব্দে বিমূর্ত চিত্র সৃষ্টির বদলে এখানে প্রকৃত চিত্রই যেন উঠে এসেছে। যুদ্ধকালীন নিত্য মুহূর্তে যে ঘটনা ঘটছে, সেসবই এখানে দগদগে হয়ে ফুটে আছে। স্বাধীনতার জন্য গোটা জাতি যে উন্মুখ অপেক্ষায়, সেই ছবিও এখানে আঁকা হয়েছে। হাড্ডিসার অনাথ শিশু, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগীর আলী, জেলেপাড়ার সাহসী কেষ্ট দাস, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিয়া কিংবা রুস্তম শেখের কথার আড়ালে এখানে উঠে আসে মুক্তিকামী গোটা বাংলাদেশ। কবি যুদ্ধচিত্র তুলে ধরার সঙ্গে নিজের দৃঢ় প্রত্যয়ও গেঁথে দিয়েছেন কবিতায়—‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,/নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’
কবি শামসুর রাহমান ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’—কবিতা দুটি একই বসায় রচনা করেন। সমান আবেগে উৎসারিত এ যুগল কবিতা। পরপর দুটি কবিতা লিখেছেন। ‘স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী কবিতার মতো’, ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘আসাদের শার্ট’সহ তাঁর অনেক কবিতাই পাকিস্তানের নির্যাতন-নিপীড়নবিরোধী আবেগের ঘনঘটায় প্রাণিত হয়ে আছে।
শামসুর রাহমানের ‘দুঃখ’ কবিতায় দুঃখ কিভাবে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়, সে কথাই তুলে ধরেছেন। এ কবিতার বিনির্মাণকৌশল কিছুটা স্বতন্ত্র। পঙিক্তর শেষ চরণে ‘দুঃখ তার লেখে নাম’ বারবার লেখার মধ্য দিয়ে দুঃখের বিস্তৃতি বোঝাতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে নিজের লেখায় আনতে চেয়েছেন নতুনত্ব। ‘তিনটি বালক’ কবিতায় শামসুর রাহমান নগরজীবনের ক্ষত-বিক্ষত ক্লেদাক্ত রূঢ় জীবনের করুণ ছবি তুলে এনেছেন। ‘রুটিকে মায়ের স্তন ভেবে তারা তিনটি বালক’ চরণে গচ্ছিত আছে বাংলাদেশ। ‘মায়ের স্তন’ হয়ে ওঠে দেশমাতার স্তন। দেশমাতার স্তন থেকে বঞ্চিত শিশু প্রসঙ্গের গাঁথুনি এ কবিতাটি।
কবিতা বিনির্মাণের বিচিত্র কৌশল নিয়ে খেলেছেন শামসুর রাহমান। কবিতাশৈলীতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা প্রায় সব কবি করে থাকেন। এটাই স্বাভাবিক। শামসুর রাহমানও তা থেকে ভিন্ন নন। তবে সেই সুনিপুণ করণকৌশলে সবাই উত্তীর্ণ হন না। শামসুর রাহমান হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, দৃষ্টান্তমূলকভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছেন। ফলে অর্ধশতাধিক বছর ধরে পাঠকের কাছে সমহারে সমাদৃত।
আমাদের বাংলা কবিতার দিকে মুখ ফেরালে অনেক কবিকে স্বতন্ত্র বিন্যাসে বিকশিত হতে দেখি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে আমরা বিনয় মজুমদারের কবিতার তুলনা করলে আঙ্গিকে অনেক পার্থক্য লক্ষ করি। তাই বলে বিষয়বিন্যাসে যে অমিল নেই, তা নয়। দুঃখময় জীবনের ধারাপাত উভয় কবির কবিতায় রূপ লাভ করেছে। কবির নাম না দেখেও এ দুই কবির কবিতা আলাদা করা কঠিন কিছু নয়। পাঠক যখন এ দুই কবির কবিতা বিষ্লেষণ করবেন, তখন দুজনার কবিতায় দুঃখ কিভাবে উঠে এসেছে, তা বলবেন। কিন্তু প্রকাশকৌশল পরস্পরকে আলাদা করে দেবে। বলা হয়ে থাকে, শিল্প-সাহিত্যে বিষয়ের নতুনত্ব নিয়ে আসা এখন অনেকটাই অসম্ভব। বরং একই বিষয় নিয়ে শব্দ-চরণ-পঙিক্ত মিলে কবিতার যে অবয়ব সৃষ্টি হয়, কবিরা সেই শিল্প সৃষ্টির সাধনায় ধ্যানে মগ্ন হন। আলোচ্য কবি শামসুর রাহমানও এ সূত্রেই কবিতার আঙিনায় অমলিন। কবির উপস্থিতি আর শরীরীভাবে পাওয়া যাবে না। তাঁর কাছে আর জেনে নেওয়ার কোনো উপায় নেই কোন কবিতার কী বিষয়। সুতরাং পাঠকের যোগ্যতা-দক্ষতা-রুচি-শিল্পবোধের ধারায় কবিতার বিষয় খেলা করবে। এটাই এখন পরম সত্য। তা ছাড়া পাঠক-লেখকের কাছে বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেবেন, সেই শিল্প কবিতা নয়। সৈয়দ শামসুল হকের একটি কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। কেউ একজন তাঁকে তাঁর কোনো একটি লেখার অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—পাঠকই আবিষ্কর করুক কবিতার বিষয়। শামসুর রাহমান এখন মহাকালের কোলে নিবেদিত, আর তাঁর কবিতা পাঠকের কোলে। আমৃত্যু জীবনকে আরাধ্য করে কবিতা লিখে গেছেন শামসুর রাহমান। তাঁর জন্ম স্মরণে জীবনবা প্রণীত।
-শিলালিপি
সম্পাদক ঃ নূরুল ইসলাম নুরচান
মোবাইল ঃ ০১৭১৫-৩৬৩৩১৬
ইমেইল ঃ somoyerkheya@gmail.com
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সময়ের খেয়া