বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আমার ছোট সময় থেকে। তাই প্রতি বছর বই মেলা এলে ছুটে যাই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে। প্রতি বছর তিন চার বার যাওয়া হয়। কিন্তু ইদানিং খুব ব্যস্ত হয়ে গেছি। এবার কষ্ট করে শুক্রবার ছুটির দিনটি বেছে নিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। স্টেশন পৌছানোর ২ মিনিট আগে চট্রলা ট্রেনটি ছেড়ে গেল। মনটায় খারাপ হয়ে গেল। ভাবছি বই মেলা মনে যাওয়া হচ্ছে না। মন খারাপ করে বাসায় চলে আসবো এই মূহুর্তে একজন ভিক্ষুক আমাকে হাত ইশারায় ডাকছে। আমি প্রথমে বুঝতে পারেনি। তারপর সে হুইলচেয়ার নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। আমি পকেট থেকে বের করে ১০ টাকার একটি নোট দিলাম। কিন্তু সে টাকা টা নিচ্ছে না। তারপর ২০ টাকার একটি নোট দিলাম। তাও সে নিচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করলাম কত টাকা লাগবে তোমার ভাই? সে বললো আমার টাকা লাগবে না। আপনাকে আমি এক কাপ চা খাওয়াতে চায়, আপনি খাবেন?
আমি তো অবাক! তুমি আমাকে চা খাওয়াবে? কেন ভাই? আগে আপনি বলুন চা খাবেন? আমি কিছু সময় দাড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। স্টেশনে শত শত মানুষের আনাগোনা অথচ সে আমাকে চা পান করাবে, সত্যি আমি ভাগ্যবান। সে কি হলো স্যার খাবেন না। তুমি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জান না বা তোমার সাথে আমার পূর্ব পরিচয়ই নেই, তাহলে তুমি আমাকে চা পান করাবে কেন?
আপনি আগে বলেন খাবেন। সে তো নাছোরবান্দা আমাকে চা খাওয়াইবেই। তার অনেক জোরাজোরি পর রাজি হলাম। পাশের দোকানে যাওয়ার সাথে সাথে, সে দোকানদারকে বলল, কড়া করে এক কাপ স্পেশাল চা দেন স্যার কে। তুমি খাবে না? আমি খাবো, আমি বললাম তাকেও কড়া করে এক কাপ স্পেশাল চা দেন। তার সাথে আমার সম্পর্ক দেখে দোকানের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম স্টেশন এত মানুষ থাকতে তুমি আমাকে কেন চা খাওয়াবে? স্যার আপনাকে দেখি প্রায় স্টেশনের ২য় প্লাটফর্মে আমার মত আর একজন ভিক্ষুক আছেন তার সাথে বসে বসে কথা বলেন। মাঝে মধ্যে তার টাকা গুনে দেন। সুযোগ পেলে তার সাথে বসে চা পান করেন। আমাদের মত ভিক্ষুকদের সাথে যার এই সম্পর্ক, নিশ্চিত সে ভালো মানুষ। তুমি সুমনের কথা বলছো? ওহ...
তাহলে শোন, আমি একদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে সম পাঁপড়ি খাচ্ছি, সে আমাকে বললো স্যার আপনি কি এ যুগে এসে বাচ্চাদের মত আপনি সম পাপড়ি খাচ্ছেন। আমি বললাম আমি তো গরীব মানুষ, তোমার মত টাকা নেই তাই সম পাপড়ি খাচ্ছি। তুমি কিনে দিলে ভালো কিছু খাবো। ভাই আমাদের মত ভিক্ষুকের টাকায় আপনি খাবেন? আমি রেগে গিয়ে বললাম, তুমি ভিক্ষুক বলে কি মানুষ না? সে থেকে তার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। সে বললে তার টাকা পয়সা গুনে দেয় এই আর কি? আচ্চা বাদ দাও, চা খেতে খেতে পরিচয় হওয়া যাক, কি নাম তোমার?
আমার নাম নাদিম মিয়া, গ্রামের বাড়ি কোথায়? নরসিংদী চরে? ওহ তাই
আমার বাড়ি চরে? বাবা মা ভাই বোন কতজন?
এই কথা বলার সাথে সাথে সে কাঁদতে শুরু করলো। আমি চা রেখে তাকি জুড়িয়ে ধরলাম। তুমি কাঁদতেছ কেন? আমাকে খুলে বল? আমার বয়স যখন ছয় তখনও আমি হাটতে পারি না। আমি জন্ম থেকে হাটা চলা করতে পারি না। আমার এই অবস্থা দেখে আমার বাবা মায়ের ডিবোর্স হয়ে যায়। আমার মা আমাকে বাবার কাছে রেখে নানার বাড়িতে চলে যায়। আমার বাবা এ সাপ্তাহের মধ্যে আবার বিয়ে করে। নতুন মা কিছু দিন আমাকে খুব আদর করত। যেটা আমার নিজের মাও করেনি। বছর খানে এরমক চলছে। বছর খানেক পরে আমার নতুন মার ঘরে আসে আমার এক ভাই। সে থেকে আমার কপালে শুরু দুঃখ। নিয়মিত খাবার পাইনা, রাতে গরু ঘরে সাথে রেখে দেয়। প্রায় বলে মরতে পারি না? আমার মা চলে গেছে কিন্তু আপদ রেখে গেছে? একবেলা খেতে দিলে আর একবেলা খেতে দেয় না। আশপাশের কেউ খাবার দিলে ও অনেক ঝগড়া করে। মানুষকে শুধু শুধু গালি-গালাজ করে। একদিন আমার চাচির সাথে মারামারি হয়েছে। আমার চাচির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে আমার নতুন মা। এই নিয়ে এলাকায় অনেক বিচার হল। একদিন রাতে আমার নতুন মা এবং তার মা ( নানি) মুখ বেঁধে আমাকে এই স্টেশনে লাইনে ফেলে চলে গেছে। এমন সময় আমার পাশে এলাকার চাচা চাচি আমাকে স্টেশনে দেখে ফেলে। তারা আবার নিঃসন্তান। তারা হয়তো ঢাকা থেকে আসছে রাত করে। তারা আমাকে দেখে চিনে ফেলে। তারা আমাকে লাইন থেকে তুলে আমার সব কিছু জানতে পারে। তারপর থেকে তারায় আমাকে লালন পালন করে বড় করেছে। আমি এতদিন ভিক্ষা করেনি। বাড়িতে একটি ছোট্ট মুদির দোকান চালাতাম। বাবা এখন অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন। তাই প্রতি শুক্রবার হলে চলে আসি। কিছু টাকা ইনকাম হলে সংসার টা ভালো চলে। তার কথা গুলো আমি একা না চা স্টলের সবাই মনোযোগ সহকারে শোনছে। প্রত্যেক চোখের কোণে পানি লক্ষ করলাম। আমি কাঁদতে ছিলাম। সে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে স্যার আপনি কাঁদেন কেন? তুমি আমার ভাই, তাই তোমার জন্য আমি কাঁদি।
তার কথা শুনে স্টলে বসে থাকা সকলে তাকে দুইশত তিনশত কেউ পাঁচ শত কেউ হাজার টাকা তাকে উপহার দিতে থাকে। আমাকে বলতেছে আমার টাকা গুলো আপনি গুণে দিবেন? অবশ্যই কেন না।
গুনে দেখি প্রায় ছয় হাজার টাকা পেয়েছে। সে তো মহা খুশি সাথে আমিও। আমি চা বিল দিতে গেলে খুব অভিমান করলো আমার সাথে। তার মুখে হাসি ফোটাতে আমি আর বিল দেয়নি। আসলে আমাকে চা খাওয়ানো উদ্দেশ্য কি? জানতে পারি? স্যার আপনার সাথে একটি সেলফি তুলবো,
তাই, জ্বি
আমি তো বিশেষ কেউ না তুমি আমার সাথে সেলফি তুলবে। আমাকে একটি কথা দিবেন , বলও আমার সাথে যে সেলফি তুলবেন সেটা কিন্তু ফেসবুকে দিবেন প্লিজ।
আচ্ছা ঠিক আছে? তার সাথে সেলফি তুলে বিদায় নিলাম। উপকূল ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সারা রাস্তা মনে হলো আমাকেও মানুষ ভালোবাসে।
সম্পাদক ঃ নূরুল ইসলাম নুরচান
মোবাইল ঃ ০১৭১৫-৩৬৩৩১৬
ইমেইল ঃ somoyerkheya@gmail.com
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সময়ের খেয়া