
ছবি : সংগৃহীত
ড. এস এম শাহনূর
পেপার, নিউজ পেপার, টাটকা খবর, গরম খবর, পেপার….শরতের রোদেলা সকালে পেপার ওয়ালা ছেলেটির নরম সুরে পেপার শব্দটি শুনতে বেশ মধুর লাগল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় বসে আছি। আমার অপেক্ষা চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন। গন্তব্য চট্টগ্রাম।
এক সময় সেই পেপার ওয়ালা ছেলেটি মুক্তো ছড়ানো একটি হাসি দিয়ে আমার সামনে বেশ কয়েকটি পত্রিকা ময়ূরের পেখমের মত তুলে ধরে বলল- ম্যাডাম আজকের পেপার লাগবে ? আমি একটি পত্রিকা নিলাম। ভাংতি টাকা না থাকায় একটি একশত টাকার নোট বের করে ওকে দিয়ে বললাম- ভাংগতি হবে তো ? ছেলেটি হাস্যউজ্জ্বল,
বদনে বলল – Yes Madam. ক্ষণিকের ব্যবহারেই সে আমার মনে একটু জায়গা করে নিল। ছেলেটির প্রতি আমার একটু মায়া জন্মাল। এই এতটুকু ছেলে যে বয়সে কাঁধে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। ক্রিকেটের বল ব্যাট নিয়ে রোদেলা দুপুরে মাঠে মুখরিত থাকার কথা। সেকিনা জীবিকার প্রয়োজনে প্রত্যুষে পেপার-পেপার বলে বেড়ায়! কে নিবে, কে নিবে এদের দায়িত্ব? আমি ? নাকি সরকার? ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ল যখন মাইকে এ্যানাউন্সড হচ্ছিল, ‘চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী অনির্ধারিত কারণে ১ঘন্টা দেরিতে আসবে। যাত্রী সাধারণকে ধের্য্য সহকারে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। ধন্যবাদ।’
হ্যাঁ ধন্যবাদ ছাড়া স্টেশন কর্তৃপক্ষের আর কীবা করার
আছে ? ভাগ্য ভাল যে, ১ ঘন্টা দেরিতে হলেও ট্রেন
আসবে। না আসলেও তো যাত্রীদের কিছুই করার নেই।
পেপারওয়ালা মিষ্টি ছেলেটির হাতে থাকা পেপার গুলো
বিক্রি শেষ। আমার বেঞ্চের পাশে এসে আনমনে
রেললাইনের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। আমি
ইশারায় ডেকে পাশে বসালাম। জিজ্ঞাসা করলাম
কি নাম তোমার? উত্তরে বলল-চন্দ্র। কে বলে
তোমার নাম চন্দ্র। তুমি তো চাঁদের চেয়েও সুন্দর।
পড়াশুনা কর ? চন্দ্ৰ উত্তরে বলল, “তৃতীয় শ্রেণীতে
পড়ি, মা অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য বেশ টাকা প্রয়োজন,
বাবা বেঁচে নেই। তাই সব সময় স্কুলে যেতে পারি
না।” আমি চন্দ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
সে বেড়াল ছানার মত আমার আদর গ্রহণ করল।
একটু হেসে বললাম-তুমি আমাকে একটা কবিতা শোনাতে
পারবে চন্দ্র? এবার চন্দ্রের মুখে যেন খৈ ফোটে।
-আমি হবো সকাল:বেলার পাখি….
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি।…
এক সময়ের বহু পঠিত কবিতা চন্দ্রের মুখে শুনতে শুনতে
চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন হুইসাল বাজিয়ে
ষ্টেশনে এসে থামল। আমার মত অপেক্ষমান যাত্রী সাধারন যে যার বগির দিকে ছুটে চলছে। আমাকেও যেতে হবে। তবু চন্দ্রের জন্য কিছু একটা করণীয় আমাকে প্লাটফর্মে আটকে রাখে। ব্যাগ থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে শাড়ী কেনার টাকাটা বের করে চন্দ্রের হাতে দিয়ে বললাম, এই নাও
তোমার মায়ের চিকিৎসার জন্য। চন্দ্র একবার আমার
মুখের দিকে তাকায়, একবার চকচকে নোটগুলোর দিকে
আরেকবার ট্রেনের দিকে। আমি ট্রেনে উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। তাকিয়ে দেখলাম চন্দ্রের চোখে পানি। হাত উঠিয়ে বলছে, ‘Good bye Madam.’
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।